।। বাক্‌ ১৪৩ ।। অণু গল্প ।। আবেশ কুমার দাস ।।





আবেশ কুমার দাস
খেলনা

ট্রিগারে চাপ দিলে এখনও ঘড়ঘড় করে মেশিনগানটা। লাল ব্যাকলাইট বাদে প্রায় অক্ষতই আছে হলদে স্কুটারটা। স্টিম ইঞ্জিনের জানলায় সাঁটা ড্রাইভারের ছবিওয়ালা স্টিকারটা আজও সেঁটেই আছে যথাস্থানে। এক-একটা বাচ্চা হয় না এক্কেবারে রাম-ডোকলা! খেলনা হাতে পেলে ভেঙে দেখে চলে কিনা। অমন অসভ্য ডানপিটে কোনওকালেই ছিল না বাবান। প্রায় দম দেওয়া একটা পুতুলের মতোই বাধ্য ছিল মালবিকার।
       ছেলের ছোটবেলার খেলনাগুলোকে তাই আজও দেয়াল আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে পেরেছে মালবিকা।
       লোকজন এসে বসে এ ঘরে। তাকিয়ে থাকে কাচের দিকে। কেউ দু’ কথা বলেই ফেলে মুখ ফুটে। কেউ শুধুই দেখে যায় দু’ বছর আগেও অমন মুগ্ধ চাহনিতে ফুলে উঠত মালবিকার বুক এন্ট্রান্সে তুখোড় র‍্যাঙ্ক করে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকেছে সেদিন বাবান। অতিথিদের চোখের তারায় বাড়তি সম্ভ্রম।
       আজও আসে অতিথিরা। রেখাই যেমন বলছিল এই মুহূর্তে, আলমারি দেখেই বোঝা যায় কাকিমা। ছোট থেকেই কত বাধ্য ছিল ভাই...
       হাসির আড়ালে বুকটা চিনচিন করে ওঠে ইদানীং মালবিকার। টের পায় জং ধরছে দম দেওয়ার চাবিটায়। পড়াশোনায় যেন আর মন নেই বাবানেরদিনে দিনে খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে রেজাল্ট। নিজেকে আমূল বদলে ফেলে বন্ধুর মতো মিশে বোঝার চেষ্টা অবধি করে ফেলেছে মালবিকা। কোনও চূড়েলের পাল্লায় পড়েছে নাকি ছেলে...
       পাশের ঘর থেকে রেখার কথাটা কানে গিয়েছে বাবানেরও।
       সেদিন বলছিলেন বিডি, আসলে তত কনসাস তো নই আমরা। যেসব বাচ্চা একটা খেলনা হাতে পেলেই পনেরো মিনিটে খুলে ফেলছে তার কলকবজা, আমরা ভাবছি খুব দুরন্ত, আসলে তাদের মধ্যেই রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারের বীজ। আর যাদের যত্ন আছে একটা সুন্দর খেলনার, তারা হতে পারত ভাল আর্টিস্ট...
       লিটারেচার নিয়েই তো পড়তে চেয়েছিল বাবান।




ষাঁড়ের দুধ

নিশুতি পথে হেঁটে আসছিল ছায়ামূর্তি দুটো।
সরাইখানায় দরজায় লেখাটা দেখলেন আসার পথে?
       দেখলাম। এখানে গরু বা শূকরের মাংস পাওয়া যায় না।
       খাটালটার সামনে কিন্তু লেখেনি ওখানে ষাঁড়ের দুধ পাওয়া যায় কি না।
       কী আশ্চর্য! যার অস্তিত্বই নেই তাকে কেন খুঁজবে লোকে! আর তখন আলাদা করে বলে দিতেই বা হবে কেন!
       তবেই দেখুন। সেই যে কবে থেকে ‘তিনি নেই তিনি নেই’ বলে গলাবাজি করে আসছে ওরা, তাতেই প্রমাণিত হয় যে তিনি মোটেও ষাঁড়ের দুধের মতো কিছু নন।
       থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে দ্বিতীয় মূর্তিটা। কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। আবার বলে ওঠে সে, একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে কিন্তু আপনার যুক্তিতে...
       কেমন?
       আপনি তো জানেনই অবিশ্বাসী আমি নই। কিন্তু বিশ্বাসের ভিত মজবুত বলেই চাইব না কুযুক্তি খাড়া করে নিজেরই সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে। দেখুন, যদি আজন্ম শেখানো হত যে ষাঁড়ের দুধেরও সত্যিই অস্তিত্ব আছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, একদল লোক কিন্তু বিনা প্রশ্নে মেনেই নিত কথাটা। আর-একদল মানুষকেই তখন আবার নামতে হত সত্যের সন্ধানে। সুতরাং ভেবে দেখতেই অনুরোধ করব আপনাকে আবারও। বিশ্বাসীর সংখ্যা বাড়াতে চান, নাকি ভক্তর...

পরদিন ভোরেই বাজারের রাস্তায় পাওয়া গিয়েছিল লাশটা।



চিন্তা

মদ। মাংস। মিষ্টি। চিন্তা।
       মাংস। মিষ্টি। চিন্তা।
       মিষ্টি। চিন্তা।
       চিন্তা।
       চিন্তা...

কী এত চিন্তা করেন বলুন তো! যে রোগটার নাম করলেন, কোটিতে একজনের হয় ওটা...
       একশো তিরিশ কোটি মানুষের দেশ আমাদের ডাক্তারবাবুতাহলে ঠিক এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে একশো তিরিশ জন মানুষ ভুগছে এই রোগটায়...
       ইয়েস। এত বড় দেশে মাত্র একশো তিরিশ জন। ক্যান ইউ ইমাজিন হাউ নেগলিজিবল ইজ দ্য নাম্বার! ঠিক এই মুহূর্তে সারপেন্টাইন লেনের এই এঁদোগলিতে বসবাস করছে তার কয়েকগুণ বেশি লোক...
       কিন্তু সেই একশো তিরিশের একজন যে আমি নই তার নিশ্চয়তা কী?
       কী আশ্চর্য! সেভাবে ভাবতে গেলে তো আমিও হতে পারি সেই একজনকিন্তু এত নেগেটিভ চিন্তা করতে যাবই বা কেন অহেতুক?
       দেখুন, আমার তো মনে হয় চিন্তা চিন্তাই। তার কোনও নেগেটিভ-পজিটিভ নেই। ওই বিষয়টা স্রেফ আমাদের আরোপিত। এই দেখুন না, যে দেশে শিশু বাঁ হাতে খেলে, লিখলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসা হয়, সেই দেশ থেকেই উত্থান ঘটতে পারে বিশ্ব পর্যায়ের চায়নাম্যান স্পিনারের, কখনও কি ভাবা গিয়েছিল...
       মাই গড। দেখুন, স্রেফ এই একটাই রোগ আপনারআর তা হল এই আকাশকুসুম চিন্তা...
       তাহলে এখন কী হবে ডাক্তারবাবু!
       কিছুই না। এই চিন্তাগুলোই ছাড়তে হবে আপনাকে।
       কিন্তু...

চিন্তা...
       চিন্তা।
চিন্তা। মিষ্টি।
চিন্তা। মিষ্টি। মাংস।
চিন্তা। মিষ্টি। মাংস। মদ।



2 comments: