।। বাক্ ১৪৩ ।। অর্ক অপু।।


অর্ক অপু

উসমান রঙের দিন

উসমান,
খুব ভালো আছো নিশ্চয়।
চিঠিটা তুমি পাবে কী না জানি না।
হয়ত লেখা শেষ হবার আগেই 
ছিঁড়ে যাবার আঘাতে 
কাগজের পরিবার ভাঙা টুকরোগুলো
আহত প্রজাপতির মতো ঘুরতে ঘুরতে
বারান্দা থেকে পড়ে যাবে পায়ে হাঁটা রাস্তায়।
অথবা
ভবিষ্যতের মতো অন্ধকার এক ড্রয়ারের ভেতর
তাকে লুকিয়ে রাখবো নিজে নিজে,
যেন কেউ জানতে না পারে
আগামী দিনের আকাশের রঙ।
উসমান,
তুমি কী ভালো আছো?
এই চিঠি যদি ডাকবিভাগের অবহেলায়
না পৌঁছায় তোমার কাছে,
তুমি কী ভালো থাকবে?

কাশফিয়া,
তুমি যতগুলো তীর আমার নামে
আমার সুঠাম বুকের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছো,
তার একটির নিশানাও ব্যর্থ হয়নি।
এমনকি অন্যের দিকে ছুঁড়ে দেয়া তোমার তীরগুলো 
আমার বুকে এসেই লাগতো, হয়তো লাগে এখনো।
তোমার চিঠিটা আমার বুক পকেট পর্যস্ত পৌছাতে
কোথাও বাধা পায়নি।
তবে ভালো আছি কী না? এই প্রশ্নটা
গলায় বিঁধে আছে বেখেয়ালে তাড়াহুড়ো করে খাওয়া
মাছের সুচালু কাঁটাটির মতো।
আমি অপরাধবোধ গিলে খেয়ে কেমন থাকবো?
তা তোমার চেয়ে ভালো আর কারো জানার কথা নয়।
নিশ্চয় তুমি আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না
বাসস্ট্যান্ডের মসজিদেও সেই কোনটির কাছে,
যেখান থেকে আমাদের পালিয়ে যাবার কথা
এখনো অটুট আছে।

উসমান,
তোমার ফিরতি চিঠি পড়ে
গতরাতে অনেকক্ষণ ধরে হাসলাম।
তুমি বিশ্বাস করবে কী না জানি না,
সেই হাসি
আমার হাজার রাতের কান্নার চেয়েও বেশি কুৎসিত।
আমাদের আর কোনো কথা অটুট নেই।
এমনকি আলোকিত স্মৃতিগুলো
গভীর অন্ধকারের দিকে ডুবতে বসেছে।
তুমি এখনো কী দারুণ অবুঝ।

পুনশ্চঃ আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে।

নতুন জীবনের শুভেচ্ছা তোমাকে শুরুতেই।
আমি ধরে নিলাম এই চিঠি পৌছাতে পৌছাতে
তুমি রঙ মেখে নিয়েছো হাতে।
নাকের পরে দারুণ বসেছে নকশার নাকফুল।
ঘোমটা মাথায় তোমাকে কেমন লাগছে দেখতে?
তুমি কি সামান্য ঘামছো?
তোমার দায়িত্ববান বরটির জন্য
যখন বিরিয়ানি রাঁধবে,
সেখানে তেল কম করে দিও।
আজকার হার্টের সমস্যা
অনেক বেড়েছে আমাদের চারপাশে।

উসমান,
আমার সম্ভাব্য বরটিও হয়তো তোমার মতো,
যার হৃদয় বলে কিছু ছিলো না।
বিয়ের দিন আমাকে উপেক্ষা করে
সে তার ব্যক্তিগত কামনার নারীটির সাথে
চলে গেছে নিজের পথে।
আমার কথা একটিবারও ভাবেনি তোমার মতো।
তোমাদের এত মিল?
এবারও আমার সংসার হলো না।
বাদ দাও আমার কথা,
তোমার মেয়েটি কেমন আছে?
ওকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করে।

কাশফু,
তোমার চিঠিটা পড়ে আরো আরো বিষণœ হয়ে যাই।
জানোতো- এখনো আমার নিজেকে
খুব অপরাধী অপরাধী লাগে। 
যদিও শাস্তিটা আমি ঠিকই পাচ্ছি,
যার ভার হয়তো তুমি কোনোদিনই বুঝবে না,
অথবা আমি বোঝাতে পারবো না।
জানো, আমাদের মেয়েটা খুব ল²,
একেবারে তোমার স্বভাবের।
মায়ের সাথে বনে না তার।
সে স্কুলে যাবে না চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত,
সে নাচ শিখবে, এমন পণ নিয়ে
মায়ের সাথে প্রতিদিনই তার ঝগড়া হয়।
আচ্ছা কাশফিয়া,
তুমি কী তোমার নাচের স্কুলটা এখনো চালু রেখেছো?

উসমান,
ওসব কিশোরি বয়সের খেয়াল, কতদিন আর থাকে বলো।
নাচুনে মেয়েকে কোনো পরিবারই আপন করে নেয় না,
তোমাদের মেয়েকে কথাটা ভালো মতো বলে দিও,
আরো বলে দিও
সে যেনো হুট করে নয়, ধীরে ধীরে বড় হয়। আর বোলো
পুরুষের সব কথা বিশ্বাস করতে নেই। 
সে যেনো কারো অপেক্ষা না করে কোনোদিন।
উসমান,
তুমিও আর কোনোদিন আমার চিঠির অপেক্ষা কোরো না।



অমল আমার অমল

অমল নামের নির্মল প্রেমিককে চিনি আমি। বহুদিন তার সাথে আমার ভাব ছিল। শরীরে শরীর মিশে ছিল। বহুদিন আমরা একে অপরকে কবিতা পড়ে শুনিয়েছি। হাতের মুঠোয় ভাত নিয়ে তুলে দিয়েছি একে অপরের মুখে। পরস্পরের চোখে আমরা কেঁদেছি বহুরাত। খলখল হেসেছি সদ্য ফোটা খইয়ের মতো। বহু বহু অফুরন্ত সময় আমাদের ছিল। আমাদের সে সমস্ত সময়কে ফাঁকি দিয়ে অমল ক্লাব থিয়েটার মঞ্চে অভিনেতার চাকরি নিয়েছিল। কী চমৎকার মুখস্ত সংলাপ বলতে পারতো সে। টিভিতেও তাকে দেখা গিয়েছিল অনেকবার। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখে গেছি। অমলকে দেখতে পেলে আমার হৃদয়- গুহার জলের মতো শীতল হয়ে যেতে আরামে।
 শৈশবে অমলের সাথে দেখা হয়েছিল শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ঠাকুর সাহেব ডাকঘর নাটকের ছলে আমাকে শুনিয়ে গেছেন অমলের শৈশবের কথা। সেখানে জানালার ধারে অমল যে আসলে কার অপেক্ষা করেছিল, কার অপেক্ষা! আমার হাজার বছরের অপেক্ষার কাছে কত ঠুনকো লেগেছিল দইওয়ালার সেই অমলকেসুধা বালিকা ফুলের গল্প বলতো জানালার ধারে বসা আমার অপেক্ষার অমলকে, সে ফুল যে আমি নিজে ছিলাম তা কী বুঝতে পেরেছিল কেউ? কোনো দেবতা কী পায়ের অর্ঘ্যের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে প্রেমিকার নিবেদন? অমল রাজার হাত ধরে চলে যাবার পর অনেকদিন তার কোনো খোঁজ পাইনি।
তখন আমার অপেক্ষার প্রহর কাটতো গান শুনে শুনে। মান্নাদের কফি হাউজ গানে অমলকে খুঁজে পেলাম পুনর্বার। অনেকটা বিষণ্ণ, অনেকটা রোগা, অনেকটা হতাশ, পরাজিত। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানোর অভ্যাস চালু করেছিল অমল। তার বন্ধু নিখিলেশ, মঈদুল, দিসুজা, রমা- সবাই নাকি হেরে হেরে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছিলো অন্ধকারে। সেখানে ঝলমলে আলোর মতো সুজতা উজ্জলতার গল্প বলে বলে আলোকিত করেছিল চারপাশ! সে আলোর ছটা আমার অমলের গায়ের ঘ্রাণে, হৃদয়ে লাগেনি! অমল অনেকগুলো কবিতা লিখেছিল আমাকে নিয়ে। ওর বন্ধুদের কাছে শুনেছি, সে সব কবিতা নাকি দুর্দান্ত চমৎকার। কিন্তু সেই কবিতাগুলো কোথাও ছাপা হয়নি বলে অমলের সেই কবিতাগুলো মুছে গেছে, সময়ের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে। প্রতিভার দামটা কোথাও পায়নি অমল, কোনো জীবনে কারো কাছে।
অমলের দুঃখে আমি গান শোনার পর্বটিকে বাতিল করে দিয়ে কবিতা পড়া শুরু করেছিলাম। আহা কী আশ্চর্য! সেখানেও অমল। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কী চমৎকার তুলে আনলো আমার অমলের গতিপথ। আমার অমল স্কুলের পড়া পারতো না। শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে অবাক হয়ে তাকাতো... অমলের এই অবাক হওয়া চোখকে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনি। সে চোখের ভাঁজকে আমার মতো নির্মল কোরে আর কেউ চেনে না। জানালার বাইরে তাকিয়ে অমল কতবার আমাকে ডেকেছিল, নিখাঁদ বলেছিল- চল আমরা রোদ্দুর হয়ে যাই। চল আমরা ঘর থেকে পালাই। বাইরে আমাদের দইওয়ালা আছে, সুধা আছে, নিখিলেশ, দিসুজা, মঈদুল, রমা আছে, আছে কবিতা, আছে অসীম দিগন্ত, চল চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে রে।
আমি অমলের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে পারিনি সেদিন। অমল একাই লাল সূর্যটার মতো নিস্তেজ শরীর নিয়ে ডুবে গিয়েছিল নির্ধারিত দিকের পশ্চিমাকাশে। তারপর ক্রমশ যে অন্ধকার আমাদের জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল, তা আর কাটছে না। লক্ষাধিক ল্যাম্পপোস্ট জ্বালিয়েও কাটছে না সে অন্ধকার। সুজতা তার ঝলমলে আলোতেও কাটাতে পারছে না সেই অন্ধকার। সুধা বালিকা এখনো মাঝে মাঝে অন্ধকার থেকে অমল অমল বলে ডাক দেয়। দইওয়ালা দীর্ঘ স্বরে ডাক দেয়, দই- দই- ভালো দই। কিন্তু অমল! অমল কই?

No comments:

Post a Comment