।। বাক্ ১৪৩ ।। অনন্ত নক্ষত্র বীথি ।। শক্তি সেনগুপ্ত ।।







শক্তি সেনগুপ্ত-র কবিতা


চাঁদমারি

জৈন মন্দির খসে পড়া পদ্মপাথরে বসে এতক্ষণ বিটু আর মৌ
দেখছিল আঙুলের গুণফল মুহূর্তে মৃদঙ্গ হয়ে বাজে
তবে কি পাথর মানুষের অভ্যুদয় অথবা সভ্যতাবিলয় কথা জানে

এ গ্রামের পূর্বপুরুষ যাঁরা নদীপথের বেলেমাটির মায়া
আর শুঁদি শালুকের আঁশগন্ধ ছেড়ে বেশিদূর যেতে চায়নি
তাঁদের কজন— অর্জুন পলাশ আর বাঁকশিমূল হয়ে অকারণ
এক গম্ভীর মাহাত্ম্যঘেরা অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন
সে আঁধার এমন সম্পূর্ণ যেন চিতাপলায়িতা কেউ লুকিয়ে রয়েছে

বিটু আর মৌ এখনো জানে না— দুপাশের গরমের ধানে
ঢাকা আছে মহাবীর সিদ্ধভূমি, জানে না মন্দিরের দুর্গম গোপনে
এই সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত শঙ্খিনী দৃশ্যবিভ্রমে আর বাতাসিভাষায়
অধঃপুষ্পী হয়ে ওঠে। জানে না যে একটু পরেই স্বচ্ছ ঘোড়ার পিঠে চড়ে
দীগর দুর্জন সিং এই পথে যাবে,
তার কাছারি লুঠের টাকা ঢাকা আছে পদ্মপাথরে

বিটু আর মৌ কি চাঁদ ওঠা দেখে তবে যাবে
চাঁদ অত সহজে ওঠে না, কাঁধের পিছনে অন্ধকার
তারাজাগা ঘোলাটে আকাশ, স্মৃতির দূরত্ব— তবে চাঁদ

দেহহীন, স্থাবর সম্পত্তিহীন, অদৃশ্য— অথচ সচল
তারাই ঘোষণা করছে আঁধারের সত্ত্ববিধান
দিনের আলোর চিহ্ন জাগিয়ে রাখছে শুধু কয়েকটি ছোট্ট জোনাকি

বিটু আর মৌ এখনও তো উঠে যাচ্ছে না
সময়ের ভাবনার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা—
এ এক জ্বালা হল দেখি

তবে আমাকে দেখলে যদি উঠে যায়— এই ভেবে আমি
গিয়ে দেখি— বিটু আর মৌ নয়
বসে আছেন চণ্ডীদাস ও রামী।


যাবো অভিজিৎ মাসে

বারো পূর্ণিমায় তুমি সম্বৎসর কাটালে কৃপণ
অথচ চাঁদকে দিলে সাতাশ নক্ষত্র অধিকার
ওই বঞ্চনায় ক্ষুণ্ণ তারাদের অধিবাস, আর আমার ছিন্ন পরমায়ু
আর কি ফিরিয়ে দেবে সাতাশটি চান্দ্রবার, রাহু ও কেতুর নামে বার?

সে রকম হলে এই কালদণ্ড আমি যবিষ্ট অগ্নির কাছে
নিজেই অর্পণ করবো, ভাসানমুকুরে স্বর্ণপ্রতিমার গলে যাওয়া
দু দণ্ড দাঁড়িয়ে দেখব, হেমন্তকে ডেকে বলবো
ওই তো সবুজ বর্ণ চলে যায়, তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে

উত্তর আকাশে ওই সাতাশ আলোকবর্ষ দূরে
শূন্য অভিজিৎ, শূন্য তার শক্তির ধ্রুবক
সেখানে পূর্ণিমা হলে একক নীলাভ তারা জন্ম নেবে
এক কণা শূন্য পরিসরে।

তার অভিকর্ষে আমি সাতাশ নক্ষত্র পার হয়ে
যদি রোহিণীউদয় দেশে যাই 
যাবো অভিজিৎ মাসে, কেতুবারে।


জিনোম ও যমচিত্র

পুঞ্জিভূত জ্ঞানের জগতে সবই পটচিত্র
তবে জিনোমে প্যাঁচানো, যমচিত্র সোজা

যমচিত্রে কাণ্ডজ্ঞান নেই, পরাজ্ঞান আছে

গির্জের ঝোলানো বাতিগুলির দোলন দেখে
গ্যালিলিওর পরাজ্ঞান জন্মেছিল
সেই পরাজ্ঞান কাজে লাগিয়ে যারা ঘড়ি বানালো
তারা কাণ্ডজ্ঞানের লোক,
জিনোম সেইরকম

বকরূপী ধর্মের কাছে পরাজ্ঞানে পরীক্ষায়
যুধিষ্টির একশোর মধ্যে একশো
কিন্তু একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলে পাশাখেলায়
তাঁকে এমন সর্বস্বান্ত হতে হয়?

পানিবুড়ো যে রকম লাঠি ঠুকে ঠুকে
বলে দিতে পারে কত ফুট নীচে জল
যমচিত্র সেরকম পারে না,
জিনোম পারে

তবু ভয়-
কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে না কুমির বেরোয়


মাকড়সা

মাকড়শাহ। আপনিই ঈশ্বরের উৎকৃষ্ট নকল
জালশয্যাশায়ী আপনি কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রাতিগে
যে মজায় দোল খান মিচকে মুদ্রায়, পতঙ্গের সাধ্য নাই
সে গভীরগাড্ডা থেকে উঠে আসা- বাঁচা।

আলোর উৎসের ঠিক দুরূহ কোণটিতেই
আপনার গুর্জরীশ্রেণি নিঃসারিত রসময়
অক্ষাংশ মণ্ডলে এ সব ব্যবস্থাপনা কি নিখুঁত কাজ

এদিকে ধনুর্বাণ ফেলে দিয়ে বেপথু অর্জুন
একটু একটু কাঁপে। সাঁই ও গোঁসাই আপনি সমর্থবিরাজ


সাপ

মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম
কিন্তু যেই আমার শরীর এড়িয়ে সাপ
হন্হন্করে ছুটে যাচ্ছে ঝোপের ভিতর
যে ছেলেটা প্রজাপতির পিছনে পিছনে ছুটে যাচ্ছে
তার দিকে, আমি আর লুকিয়ে থাকতে
পারলাম কই? আমিও ইঁদুর হয়ে সাপের
সামনে ছুটে যাই, বলি সাপ আমাকেই খা
দেখ দুরন্ত রোদের মধ্যে ওকে কেবল
ডেকেই চলেছে ওর মা


কবিতা আফিম

পিঠের খোলাটি বেশ শক্ত থাকলে
কানে একটি খাটো হলে
খোলসের ভিতর ঢুকতে পারলে
অনেকেই দীর্ঘজীবী হন।
যেমন কাছিম

দু রকম তত্ত্বের তর্কে
স্থিতাবস্থার ঠান্ডা হাওয়ায়
একটু ঝিমোতে পারলে
অনেকেই মহামান্য হন
যেমন হাকিম

ধৈর্য হে পরম
সংরক্ত বমনে পুষ্ট তুমি
অসময়ে ভেঙে দিয়ে বিনতারা ডিম
ফুলের মালায় বিষ দিব্যি হজম করো
কবিতা আফিম


বাল্মীকি 

বললে পাপের ভাগ নেওয়া যেত
তার জন্য মরা মরা জপ
তার জন্য উইঢিপি ঢাকা
দস্যুতায় কত পাপ হবে?
তাই বলে রামের জন্মের আগে
রামায়ণ লেখা
সে পাপের ভাগ কেউ নেবে?


রতন

উলাপুর থেকে ফিরে পোস্টমাস্টার শুতে গিয়ে দেখলেন

মশা নেই, স্থানীয় অস্বাস্থ্য নেই, সমীহ করার মতো অন্ধকার নেই তবু কোলহারা সেই অনাথিনী, এক হাতে দ্বিতীয় ভাগ আর হাতে যমপট নিয়ে মশারির ভিতরে ঢুকছে।



রাত্রি ও রাক্ষস

এই মাঠে রাক্ষস নেমেছে
রাত্রির বীক্ষণবিন্দু থেকে নীল আলোকণাগুলি
খুঁজে ফেরে উৎপত্তিহীন অন্ধকার, তার ভান ও ভনিতা
আর লুকানো আগুন।

গতরাতে বিদিশার গজদন্ত খোদাই-এর দলবল
এই মাঠে এসে যক্ষীদের কোমরের আংটায়
সযন্তে সাজানো অন্তর্বাস ভাঁজ খুলে ফেলেছিল
মনে হল, সে সব দুরূহ নক্সা তাদের পছন্দ হল না
তাই তারা আগুনে পোড়াল।

সে আগুন আজও জ্বলছে, পুড়ছে সপিণ্ড সংহিতা
খালি পা, ধুতিও ভদ্রস্ত নয়,  এলামাটি পা
উনিই লছমনিয়া রায়? আঠারো ঘোড়ার ভয়ে
সোনার থালাটি তার পড়ে রইল অজন্তার ষোড়শ গুহায়

বাঁ দিকে বারুণী পুকুরে লজ্জায় মাথাকাটা চাঁদ
ভাসবার চেষ্টায় হাওয়া আঁকড়ে ধরে
হা গোবিন্দ! রোহিণী-সর্বস্ব নাথ
বিধবা রাত্রিকে তুমি ফুঁ দিয়েই বাঁচাবে কী করে।



ছোটো ছোটো শাঁখ

ভ্রমণকাহিনিতে যেমন লেখা ছিল তেমন তো নয়
দু’একটা ঝাউগাছ, একে তুমি ঝাউবন লিখেছ।
নানারঙের অনেক পাথ্রের কথা লিখেছিলে
দু’তিনটে পাথর আমিও দেখেছি
তাতে আর রং নেই, জলচিহ্ন নেই।

কাঁকড়ারা প্রত্যেকের পা কামড়ে ধরে আছে
পা দেখলেই পিছিয়ে যায় ঢেউ
সমুদ্ররেখায় হাঁটলে নানারঙের সুন্দর ঝিনুক কই?
মেইল মেইল হেঁটে আমি শুধু হাড় আর কয়লা পেয়েছি

আজ সন্ধ্যায় রানির ভাই-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল
সে এখন সভাকবি, তুমি যে কবিদের কথা লিখেছিলে
আমি খোঁজ নিয়েছি তারা আর কবিতা লেখে না
সরকার বিনামূল্যে খবরের কাগজ দেন তারা তাই পড়ে।

আজ ভোরবেলা আমি যখন সূর্যোদয় দেখতে সৈকতে যাই
দেখি মফসসল কলেজ থেকে যারা সব বেড়াতে এসেছে
তাদের প্রত্যেকের হাতে ছোটো ছোটো শাঁখ
শাঁখের ভিতর থেকে সমুদ্রের গর্জন আমিও শুনেছি।

কিছু ঢেউ কিছুটা এগিয়ে আবার ভেঙে যায়
তার পিছনেই ওঠে আবার নতুন ঢেঊ
তুমি ভুল করে লিখেছিলে ইতিহাস

ইতিহাস নয় আবহমানতাই সমুদ্র।



...



শক্তি সেনগুপ্ত
(১৯৩৭ – ২০০৫)

কাব্যগ্রন্থ: বড় ঘড়ির তলায় (১৯৯৫)
  যাবো অভিজিৎ মাসে (১৯৯৭)
  জিনোম ও যমচিত্র (২০০১)
প্রবন্ধ সংকলন:  দামুন্দা কপিশা শিলাবতী (১৯৯৮)
সম্পাদিত গ্রন্থ: লোকায়ত মানভূম, দুই খণ্ড (২০০০ ও ২০০২)

অভিযান [প্রকাশস্থল: বার্নপুর (১৯৬১ – ৬৪)], প্রবাহ [প্রকাশস্থল: শ্রীরামপুর (১৯৬২ - ৭২)], দৃষ্টি [প্রকাশস্থল: বৈদ্যবাটি (১৯৭০ – ৭৮), সুন্দর [প্রকাশস্থল: কলকাতা (১৯৯৫ - ২০০১)] ও আরও নানা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  

পেশা: ব্যবহারজীবী।
                                         : অনিন্দ্য রায়
Top of Form
Bottom of Form


20 comments:

  1. আশ্চর্য কালজয়ী সব কবিতা। ধন্যবাদ বাক্ এই কবির লেখা সামনে আনার জন্য

    ReplyDelete
  2. এঁর কবিতা কোনোদিন পড়িনি ভাবতে নিজেরই লজ্জা করছে

    ReplyDelete
  3. এঁর কবিতা কোনোদিন পড়িনি ভাবতে নিজেরই লজ্জা করছে

    ReplyDelete
  4. সত্যিই আমি বাক্যহারা । প্রকাশ করার মত ভাষা জানা নেই । এই কবির লেখা আজ প্রথম পড়লাম । শুধু নিজেকে ধিক্কার জানাই অমন কবিকে কেন চেনা হলো না । ধন্যবাদ বাক্ ।

    ReplyDelete
  5. সত্যিই আমি বাক্যহারা । প্রকাশ করার মত ভাষা জানা নেই । এই কবির লেখা আজ প্রথম পড়লাম । শুধু নিজেকে ধিক্কার জানাই অমন কবিকে কেন চেনা হলো না । ধন্যবাদ বাক্ ।

    ReplyDelete
  6. সত্যিই আমি বাক্যহারা । প্রকাশ করার মত ভাষা জানা নেই । এই কবির লেখা আজ প্রথম পড়লাম । শুধু নিজেকে ধিক্কার জানাই অমন কবিকে কেন চেনা হলো না । ধন্যবাদ বাক্ ।

    ReplyDelete
  7. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  8. অসম্ভব শক্তিশালী কলম..মুগ্ধ হলাম...

    ReplyDelete
  9. অসামান্য কবিতা সব! অসম্ভব চিন্তার জগৎ! দর্শন!

    ReplyDelete
  10. অসম্ভব ।অসম্ভব ।হিপনোটাইজড হয়ে গেলাম পুরো ।

    ReplyDelete
  11. ভালো লেখা।
    এ কবিকে আগে পড়িনি কেন?
    যারা দুই আর দুই চার এর কবিতা লেখে এরা কি কখনও এসব কবিতা পড়ে না?

    ReplyDelete
  12. অসাধারণ সব কবিটা ❤️

    ReplyDelete
  13. অসামান্য সব লেখা

    ReplyDelete
  14. সেসময়ে এসময়ের চেষ্টাকে সফলতা দিয়ে গেছেন। ভাবা যায়!

    ReplyDelete
  15. অসাধারণ কবিতা! সত্যিই আগে পড়িনি ভেবে লজ্জা হচ্ছে।

    ReplyDelete
  16. প্রতিটি লেখাই পূর্বে পড়েছি অনিন্দ্যদার সৌজন্যে। লেখাগুলি নিয়ে বিশদে কথা হয়েছে। আরও একবার মুগ্ধতা জানাই। ধন্যবাদ বাক্। এই বিভাগের প্রতি সবিশেষ নজর থাকবে।

    ReplyDelete
  17. অসম্ভব গুচ্ছ। ঘোর থেকে বেরোতে সময় লাগবে। চমৎকার। প্রিয় কবি। শেয়ার করলাম।

    ReplyDelete
  18. অসামান্য সব কবিতা। শেষ পর্যন্ত কোনো প্রকৃত কবি ও কবিতা অপঠিত থাকেন ন।। এই কবি ও তাঁর কবিতাও চিরিজীবী হবে।

    ReplyDelete