পারমিতা
মন্ডল
আজ এই দিনে
ভোরের পাখি কাছের
আমগাছটায় ডাকছে। আজ রবিবার। উঠব উঠব করেও উঠতে ইচ্ছা করছে না নীতার। কাল রাত
হয়েছে শুতে। গল্পের বইটা শেষ করতেই হত। শেষটা ভীষণ রহস্য সৃষ্টি করছিল। বেল বাজল, ‘বড় আশা করে এসেছি গো...’ মনে হয় খেঁদির মা এল
কাজে। অগত্যা... গ্ৰিলগেট খুলে...
—এসো, আজ এত তাড়াতাড়ি?
—হ্যাঁ গো বউদি, আচ একটু কাজ আচে বাড়িতে। তাই ভাবলাম একানকার কাজ
তাড়াতাড়ি সেরে নিই।
—কিন্তু ওরা তো
কেউ ওঠেনি। এই একটা দিনই তো...
—আমি আস্তে আস্তে
করব, বেশি আওয়াজ হবেনি গো।
—আচ্ছা, সাবধানে। তা, তোমার কী কাজ আছে জানতে পারি?
—ওই যে গো বউদি, আচ পজাতন্ত দিবস নাকি। খেঁদির ইস্কুলে অনুষ্টান আচে।
ফুল তুলতে হবে। একটা মালা গাঁততে হবে। নিয়ে যাবে ও ইস্কুলে।
—ও।
ছোটবেলার কথা মনে
পড়ে গেল নীতার। এভাবেই প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের জন্য ফুল-মালা নিয়ে যেত। কিন্তু
আজকাল...
একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে নীতা।
একটু পরে...
—মা, ব্রাশ দাও।
পরীর ডাকে নীতা
সাড়া দ্যায়, তুমি উঠে পড়েছ! নাও তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে...
—মা, আমি কার্টুন দেখব।
—কার্টুন! আজ কী
দিন তুমি জানো?
—হ্যাঁ, রিপাবলিক ডে।
—হ্যাঁ, আজকের দিনটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। টিভিতে নানা
প্রোগ্ৰাম হচ্ছে। সেগুলো দেখো, ভালো লাগবে।
—না মা। আমি
জানি। অল দ্যাট আর ভেরি বোরিং। ওসব দেখতে ভালো লাগে না। মজা আসে না।
—তুমি জানো, খেঁদি স্কুলে ফুল-মালা নিয়ে যাবে। প্রজাতন্ত্র দিবস
পালন করবে। পতাকা উত্তোলন করবে। জাতীয় সংগীত গাইবে...
—ও মা, ও তো মিড ডে মিলের স্কুলে পড়ে।
—তো! এইরকম করে
বলছ কেন!
—না, কিছু না। আমাদের তো সেলিব্রেশন হয়েছে, পার্টি হয়েছে ফ্রাইডে। এবার আমাকে কার্টুন দেখতে দাও
প্লিজ।
কোনো কথা বলতে
পারলো না নীতা। পরী ভালো স্কুলের ভালো স্টুডেন্ট। কিন্তু কোথাও যেন পিছিয়ে আছে
খেঁদির থেকে। ভয় করে নীতার, ভীষণ ভয়... ভয়
করে পরীর জন্য। ভয় করে পরীর মতো হাজার হাজার ভবিষ্যতের জন্য। ভয় করে দেশের
জন্য...
চোখের কোলে এক
বিন্দু জল জমে। মনটা গেয়ে ওঠে জাতীয় সংগীত। মনে মনে জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে হাউহাউ করে কাঁদে সে, নীরবে, নিভৃতে...
অচ্ছুত
—বাবু, আছেন নাকি
বাড়িতে?
—কে?
—আমি রহমত।
একথা শুনে
রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে এলেন অশোকা দেবী।
—ও, রহমত এসেছিস! তা ভালো! দেখিস বাপু, আমার তুলসীতলা আছে উঠোনে। পাঁচ হাত দূর দিয়ে যাবি।
—আচ্ছা মা।
—ওই এককোণে গিয়ে
বোস। তোর বাবু এক্ষুনি আসছে।
কিছুক্ষণ পরে
অমলবাবু এসে বললেন, কী ব্যাপার রহমত?
—বাবু আমার
মেয়ের সামনে নিকাহ্। যদি একটু গিয়ে আশীর্বাদ করে আসেন তাহলে আমার মেয়েটা বড়
সুখী হবে।
আড়াল থেকে রহমত
ও স্বামীর কথা শুনছিলেন অশোকা দেবী। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বললেন, না রে রহমত। ও
তো যেতে পারবে না। এখান থেকেই আশীর্বাদ করবে।
‘আচ্ছা মা’ বলে
রহমত চলে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়তে নাড়তে অমলবাবু ঘরে চলে গেলেন।
রাস্তায় জটলা
দেখে রহমত এগিয়ে যায়। পড়ে আছে একটা রক্তাক্ত দেহ। রহমত কাছে গেলে সবাই বলে ওঠে,
না না, কাছে যাওয়া যাবে না। এটা একটা
পুলিশ কেস।
একজন বলে, বেশি
প্রীতি দেখিও না। পরে পুলিশের লাঠানি খাবে।
আবার কেউ বলে,
দেখেছেন দাদা! দরদ একেবারে উথলে উঠেছে। নিশ্চয়ই ব্যাটার কোনো মতলব আছে।
রহমত তাড়াতাড়ি
হসপিটালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে।
খবর পেয়ে কাঁদতে
কাঁদতে অশোকা দেবী হসপিটালে এসে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ডাক্তার বাবু বলেন,
অমলবাবু আউট অফ ডেঞ্জার!
—রক্ত কে দিয়েছে?
—(মুচকি হেসে) যে-ই দিক, রক্তের রং তো একটাই। তাই না?
রহমতকে আড়ালে
দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অশোকা দেবী বললেন, এদিকে আয় রহমত। আমার ভীষণ রাগ হয়েছে তোর
ওপর।
—না মা, মানে, আসলে...
—তোর মেয়ের
বিয়েতে আমাকে যেতে বললি না!
বর্জন
মোবাইলে কলটা
আবার কেটে গেল। সোনালী বাথরুমে স্নান করছে। আজ রবিবার, তাড়া আছে। সপ্তাহের এই একটা দিনই তো তুষার একটু তৃপ্তি করে খায় বাড়িতে।
অন্যদিন তো অফিস ক্যান্টিনের ছাইপাঁশ। বাথরুম থেকে বেরিয়ে কল দেখল সোনালী।
তুষারের ফোন বাজার থেকে। বাজারে গেলে কতবার যে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, এটা নেব? ওটা নেব? কলব্যাক করতেই একটা অন্য গলা।
—কে বলছেন?
—আপনি কে? এটা তো তুষার মানে আমার হাজবেন্ডের নম্বর!
—হ্যাঁ, আমি ইনস্পেকটর অজিত সাহা কথা বলছি। আপনার হাজবেন্ডের
অবস্থা গুরুতর। অ্যাকসিডেন্ট! তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে আসুন।
মাথায় যেন আকাশ
ভেঙে পড়ল সোনালীর।
বাড়ির সবাই
হসপিটালে যেতে যেতে সব শেষ!
সামনেই অম্বুবাচি। শাশুড়ি মায়ের নির্দেশ, এটা পালন করতে
হয়। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সোনালী। তিস্তা সঙ্গে সঙ্গে বলে
ওঠে, তাহলে আমিও ওই ক’দিন আমিষ খাব না।
—কী বলছ ছোট
বউমা! তুমি কেন এইরকম করবে? আমার তুহিনের
ক্ষতি করতে চাও?
—না মা। আমি
কারওর ক্ষতি চাই না। আমি আর দিদিভাই একসাথে সবকিছু করেছি এতদিন। এখন আমি ওর সামনে
কী করে... দিদিভাইয়ের বয়স কম। কীভাবে ও থাকে কোনো খবর রাখেন?
—ভুলে যেও না ছোট
বউমা, আমি মা!
—তাহলে একটা কথা
বলব মা?
—বলো।
—দিদিভাইয়ের
জীবনে আবার সব রং ফিরিয়ে দিন।
—কী বলছ তুমি!
কিন্তু...
—এই কিন্তু-টাকে
বর্জন করুন মা, প্লিজ।
অম্বুবাচির দিন
সকালে বিন্দুদেবী নিজের ঘরে ডাকলেন সোনালীকে। নিজের একটা লালপেড়ে শাড়ি দিয়ে
বললেন, ‘আজ এটা পোরো বড়বউমা।’
Sob kotai khub valo
ReplyDelete