।। বাক্‌ ১৪৩ ।।একটি স্বাভাবিক মৃত্যু।। রাহুল দাশগুপ্ত।।


চিত্র রচনা : সনৎ মাইতি 



প্রথম পরিচ্ছেদ : রবিবার
Man does not learn unless he is thrashed.
Menander

চিঠিটা ভাঁজ করে শার্টের পকেটে রাখল চেরাব।
ঠাকুমা জানতে চাইলেন, কিসের চিঠি?
চেরাব জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। সামনে অনেকটা ফাঁকা জমি। সেই জমির দু-পাশে বড়ো বড়ো গাছ। সবুজ ঘাসে ভরে আছে জমিটা। মাঝখান ­­­দিয়ে চলে গেছে সরু মাটির পথ। তারপরই শুরু হয়ে গেছে বালুতট। নিচু হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়েছে সেই তটে। প্রবল গর্জন সেই ঢেউয়ের। চেরাব সমুদ্রের কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই জলে সবুজের আভা।
হঠাৎ সেই কালো ঘোড়াটাকে দেখতে পেল সে। ওটা এখানে এল কী করে? কাল রাতে এই ঘোড়াটাকেই স্বপ্নে দেখেছিল চেরাব। এখন ওটা দিব্যি সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ঘোড়ার কোনও সহিস নেই। আশেপাশে কোথাও দেখতে পেল না চেরাব। কাল রাতে স্বপ্নেও দেখতে পায়নি। ঘোড়াটি কী একা একাই এভাবে ঘুরে বেড়ায়?
ঠাকুমা আবার বলে উঠলেন, চিঠিটা দে দেখি আমাকে...
চেরাব এবার মৃদুস্বরে বলল, ঠাকুমা, এটা একটা চাকরির চিঠি...
ঠাকুমা চমকে উঠলেন। তারপর বললেন, চাকরি? কিসের চাকরি? তুই কোনও চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলি নাকি?
নাঃ! চেরাব মাথা নাড়ল।
তাহলে? ঠাকুমা বললেন। লোকে চাকরির জন্য মাথা কুটছে। তবু চাকরি পাচ্ছে না। আর তুই অ্যাপ্লাই করলি না। তোর চাকরির চিঠি এসে গেল? এ তো ভুতূড়ে ব্যাপার!
আমি কী করব ঠাকুমা? চেরাব জানতে চাইল।
এ নিশ্চয়ই কোনও ফ্রড চিঠি। শুধু শুধু আশা করিস না...
ঠাকুমা, আজই ওরা আমাকে দেখা করতে লিখেছে।
কেন?
আজই ইন্টারভিউ।
এ তো অলৌকিক ব্যাপার...
ঠাকুমা, চাকরিটা নিলে আমাকে ইউনিভার্সিটির বেশ কিছু ক্লাস মিস্ করতে হবে। ব্রেক টাইম পর্যন্ত আমি ইউনিভার্সিটিতে থাকতে পারব। তাছাড়া ইউনিভার্সিটিতে আমি যে ফ্রি টাইম পাই, সেটাও আর পাব না। সেটা কী ঠিক হবে?
নাঃ, হবে না। এই চাকরিটা তুই নিস না।
নেব না? চাকরির একটা সুযোগ! অনুরণনের কথা তুমি কী ভুলে গেলে? 
ঠাকুমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে। একবার অন্তত গিয়েই না হয় দেখে আয়।
চেরাব জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আর তখনই ওর সারা শরীরে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল। সেই কালো ঘোড়াটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। সত্যিই কী তাকিয়ে আছে? একটু যেন অন্যমনস্ক, আর দেখলেই কেমন অস্বস্তি হয়...

অন্ধ গলিটার ভেতরে ঢুকতেই একটা দুর্গন্ধ পেল চেরাব। এই গলির শেষেই সেই লাল বাড়ি। চিঠিতে ছবি এঁকে স্পষ্ট পথনির্দেশ দেওয়া আছে। বাতাস যেন হঠাৎ ভারি হয়ে উঠেছে। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে একটু অসুবিধাই হচ্ছে। হৃদয়পুরে এরকম হয় না কখনও। এখানে বাতাস স্বচ্ছ ও তেজি।
গলিটা যেন ছায়ায় ঢাকা, ঠিকমতো রোদ ঢোকে না এখানে, ভিজে ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে একটা ভাব। দু-পাশের দেয়ালগুলিতে শ্যাওলা পড়েছে। দেয়ালের ওপাশে দু-দিকেই পরিত্যক্ত, জঙ্গুলে জমি। কিন্তু সমুদ্রের গর্জন ঠিকই শোনা যায়। রাস্তটা মাটির, ন্যাড়া, কোথাও কোথাও অল্পস্বল্প ঘাস আছে বটে, তাও সবুজ নয়, ধূসর। সাবধানে পা ফেলে সে এগোতে লাগল।
বাড়িটার সামনে এসে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল চেরাব। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। সে কি ভেতরে ঢুকবে? না কি এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করে সোজা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বন্ধুদের সঙ্গে ফ্রি টাইম কাটাতে চলে যাবে? কিন্তু চাকরি বলে কথা!
চেরাবের মনে পড়ল অনুরণনের কথা। ঠিক তখনই। ওদের বাড়ির পিছন দিকেই থাকত। বয়সে ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়ো। একটা সময় খুব উজ্জ্বল চেহারা ছিল অনুরণনের। তখন সে একটা ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখত। সুন্দর একটা ভবিষ্যতেরও। একটার পর একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে গেছে অনুরণন। কোথাও চাকরি হয়নি। এক গভীর রাতে অনুরণন হঠাৎ হারিয়ে যায়। সমুদ্র অবশ্য তার মৃত শরীরটাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। অনুরণনের মা তারপর থেকেই শয্যাশায়ী। তার বাবা বেশিরভাগ সময়ই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে থাকতে পারেন না। তাঁর থমথমে মুখ ব্যথায় ভিজে থাকে। গাম্ভীর্যকেও তখন খুব করুণ দেখায়। মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তিনি অবিরাম কেঁদে চলেছেন।
অনুরণনদের বাড়ির সামনে একটা সুন্দর বাগান ছিল। কত রকম গাছ ছিল আর বাহারি ফুল ছিল সেই বাগানে। দৃশ্যে আর গন্ধে ভরে থাকত সেই বাগান। সেই বাগান এখন ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কত রকম আগাছা অর সাপ-বিছের আস্তানা। সেদিকে এখন তাকাতে পারে না চেরাব। বাড়ির পেছনদিকের জানালাগুলো বন্ধই রাখে বেশিরভাগ সময়। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে একচিলতে হাসি। সেই হাসির অর্থ বুঝতে পারে না চেরাব।
 হারিয়ে যাওয়ার আগে থেকেই সব ঠিক হয়ে থাকে। যোগ্যতা, মেধা এসব কোনও মাপকাঠিই নয়। এখানে যার পয়সা আছে, তার সব হয়। অথবা তোমার চেনাজানা কেউ থাকতে হবে। আমার তো কোনওটাই নেই চেরাব। আমার কী হবে? আমার বাবা পেনশন পান না, রিটায়ার করেছেন। মা অসুস্থ, হাঁপানির কষ্ট। কী করব আমি? কার কাছে যাব? কার কাছে সাহায্য চাইব? রাস্তার কুকুরের চেয়েও খারাপ অবস্থা আমার। রাস্তার কুকুর দরকার হলে হিংস্র হতে জানে। কামড়ে দিতে জানে। আমার তো ফোঁপানি ছাড়া কিছুই আসে না!
অনুরণনের মৃত্যুর পর ওর ঘরে, বিছানার নিচে, কয়েক হাজার চাকরির অ্যাপ্লিকেশন জেরক্স পাওয়া গেছিল। মোটা মোটা সব অ্যাপ্লিকেশন। কত পরিশ্রম আর খরচ করেই না ওইসব অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছিল সে! কত আশা করেছিল!
অনুরণন বলেছিল, এই দেশে মানুষের জীবনের কোনও দাম নেই চেরাব! বড়ো অভাগা এই দেশ! আমরা রাজনীতি বুঝি না, অর্থনীতি বুঝি না, পক্ষ-বিপক্ষ বুঝি না, পতাকা-স্লোগান বুঝি না, শুধু একটু স্বচ্ছলতা চাই, সুখ বা বিলাস নয়, নিছক স্বচ্ছলতা, যাতে একটু খেয়েপড়ে বেঁচেবর্তে থাকতে পারি। সেই সুযোগটাই কেউ আমাকে দিল না...

লাল বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ল চেরাব।

                                                       (ক্রমশঃ)


5 comments:

  1. ভালো প্রচেষ্টা

    ReplyDelete
  2. অপেক্ষায় রইলাম

    ReplyDelete
  3. বেশ অন্যরকম লেখা।

    ReplyDelete
  4. প্রথম বার পড়ে উপলব্ধি করতে পারিনি। আজ আবার পড়ে অনুভব করতে পারছি। ভীষণ ভালো লাগছে।

    ReplyDelete