চতুর্দশ পর্ব : নাগসাহ্বয়
প্রত্যহ জন্ম হয়, প্রতিমুহূর্তে অজস্র অগণন জন্ম হয়, নব
হয়, গতিশীলতা হয়। প্রত্যহ ফুল ফোটে, ফল ধরে। প্রত্যহ রবি উদিত হন। নদীজল বয়ে যায়
নিয়ত। মাটিতে বীজ পড়লো, পরদিন তার অঙ্কুর বেরোলো। তার পরদিন রোঁয়া রোঁয়া পত্র
উদ্গত হলো। দুই অঙ্গুলি মাপের উদ্ভিদ তিনদিনে আরো দুই অঙ্গুলি পরিমাণ বৃদ্ধি পেলো।
এই তিনদিন কি প্রত্যহই তার জন্ম হলো না? একটু একটু করে? বৃক্ষে পুষ্প আসে, সে কি
গাছের আরেক জন্ম নয়? ফল আসে আসে, সে আরেক জন্ম। ফুলের পাপড়ি খসে ফলজন্ম, সে কি
ফুলের মৃত্যু? সে তো গতি। ফুলের গতি হয় ফলে। গাছ নিচের দিকে যায়। মূলে। গাছ উপর
দিকে যায়। কাণ্ডশাখাপ্রশাখাপত্রে। গাছ স্থির, তবু গতিশীল। নদীজল গতিশীল, নদীও। খাত
পাশের দিকে ভেঙে যায়। নদী সে পাশে সরে যায়। নদী যেখানে পাড় ভেঙে নতুন পথ নিচ্ছে, নদী কি সেখানে জন্মাচ্ছে না? একই নদী তার বিশাল শরীরে বিভিন্ন স্থানে কি নতুন নতুন
করে জন্মাচ্ছেনা প্রত্যহ? পাথর
নদীজলে গড়িয়ে যায়। গড়িয়ে, কোথাও যায়। অথবা উপল, মাথা তুলে থাকে নদী থেকে, তার গায়ে
শ্যাওলা হয়, হয়ে পাথর, অন্য হয়। গতি। জন্ম। জায়মানতা। পাথর ভেঙে যায়। ভেঙে ছোটো
টুকরো হয়ে যায়। টুকরোগুলি নব হয়, স্বতন্ত্র জন্ম হয়, স্বতন্ত্র গতি পায়৷ জায়মানতা,
গতি, জগৎ।
জগৎ। নিয়ত জায়মান। প্রত্যহ প্রতিমুহূর্তে
বহু বহু জন্ম। প্রতিক্ষণে গতিশীল। নিয়ত জায়মান যা, গতিশীল যা, তাই জগৎ।
জগতে জনিত হয়। জনিত হয় জন। জাত হয়, নীত হয়। জাত হবার জন্য নীত হয়, জাত হয়ে নীত হয় যা, তাই
জন। জন থেকে আরো জন হয়, পরের পর জন হয়। জনে জনে অজস্র জন হয়, জনন।
জাত হতে চাওয়া, জ। যাচ্ঞা করা,
ঞ। জাত হবার যাচ্ঞা হয়। জন্মাতে যাচ্ঞা হয়। দেখা গেল, দিবাকর প্রকাশিত হলে পদ্মগুলি
ফোটে। দিবাকর প্রকাশিত হলেন এবং পদ্মগুলি ফুটলো, এ দৃশ্য চোখের সামনে যে দেখলো, সে
অন্য মানুষ হয়ে উঠলো। তার নবজন্ম হলো। তারপর সে দেখলো, প্রভাতে ফুলগুলি ফুটে ওঠে, সন্ধ্যায়
ঝরে যায়। এ বিষয় জানার পর সে আগের মানুষ রইলো না, অন্য মানুষ হলো। জল পেলে শস্য অধিক
উদ্গত হয়। ঘৃতে হুতাশন অধিক উজ্জ্বল হ'ন। বর্ষা সমাগত হলে ভেককূল কলরব করে। ময়ূর ময়ূরীকে
প্রলুব্ধ করতে নৃত্য করে। জল উপর থেকে নিচে যায়। জল শীতল হলে তুষার হয়। মানুষ দুঃখ
পেলে অশ্রুপাত করে। মানুষ আনন্দে হাস্য করে। এসব বারবার জানতে জানতে আসক্তি জন্মে যায়, অভ্যাস হয়ে যায়। তারপর যাচ্ঞা হয়। যেদিকে চোখ যায়, সেটিই জানতে
মন যায়। জানলেই সেই আনন্দময় জাগরণ, জন্ম। এই আনন্দময় জন্মজাগরণের জন্যই তারপর
বারবার নব হতে যাচ্ঞা হয়। বারবার অন্য মানুষ হয়ে উঠতে যাচ্ঞা হয়। বারবার জাত হবার জন্য যাচ্ঞা, জ্ঞ, জ্ঞান।
জন থেকে
বিশ। ব ঈ শ অ। ঈ অর্থে ক্ষেপণ। ধরা যাক, অনুবিন্দ একটি লোষ্ট্র ক্ষেপণ করলো। তা
গেল দুই কুড়ি হস্ত। মিত্রবিন্দ ক্ষেপণ করলো অপর একটি। তা দুই কুড়ি পেরিয়ে আরো
কতিপয় হস্ত দূর অব্দি গেল। তাহলে মিত্রবিন্দের ব্যাপ্তি হলো বেশি দূর অব্দি। ঈ
তাহলে ব্যাপ্তিও।
কিভাবে এই ব্যাপ্ত হওয়া যায়? ধরা যাক ক্ষেপণ, তা করে
কিকরে, কিসের সাহায্যে? তা হলো শক্তি। মিত্রবিন্দ যে অনুবিন্দর থেকেও দূরে ক্ষেপণ
করলো, অর্থাৎ মিত্রবিন্দর শক্তি বেশি, তাই ব্যাপ্তি বেশি। শক্তি বেশি বলে বেশি
দূরে ছুঁড়তে পেরেছে, বেশি জোরে ছুঁড়েছে। বেশি দূর গেছে, কারণ তাতে গতি বেশি ছিলো।
ঈ তাহলে গতিও।
এভাবে ব্যাপ্ত হতে আনন্দ হয়, আরো ব্যাপ্ত হতে ইচ্ছা হয়। শক্তির সাহায্যে
ব্যাপ্ত হয়। শক্তি, শ। ঈ এবং শ, ঈশ। ঈশ তাহলে ব্যাপ্ত শক্তির আধার। কতোটি ব্যাপ্ত?
যতোটি শক্তি। নরেশ, নরের ঈশ। যতো অব্দি নর, ততো অব্দি নরেশের শক্তির ব্যাপ্তি। নর অব্দিই।
বৃক্ষ নয়, নদী নয়, পর্বত নয়, অন্য প্রাণী নয়। অন্য প্রাণী লড়ে বা ধরা পড়ে, মরে, কিন্তু
স্বাধীন। উদ্ভিদ বদ্ধ, তবু স্বাধীন, আম্রবৃক্ষ নৃপতির কথায় জম্বুফল দান করে না। নদী
নরেশের কথায় গতিপথ পাল্টায় না, পর্বত নত হয় না। নরেশ তদ্দুর, যদ্দুর নর।
জন ক্রমে ব্যাপ্ত হয়। ব্যাপ্ত হয়ে শক্তির আধার হয়। এই
শক্তির আধারকে বহন করতে লাগে। বহন, ব। বহন করে ঈশ-কে। ব ঈশ। বিশ। জন বিবর্তিত হয়
বিশ-এ।
ভূমির সীমা দেখা যায় না। যেখানে সীমান্ত, সেখানে পৌঁছোলে
দেখা যায় সীমান্ত দূরে সরে গেছে। নিজের ছায়াকে যেমন পেরিয়ে যাওয়া যায় না, দিগন্তকে
তেমনই ছোঁওয়া যায় না। অর্থাৎ এ ভূমি নদী পর্বত বহু বহু আছে। নিশ্চয়ই অনেক অনেক জন
আছে। অনেক বিশ আছে। এই বহু বহু বিশ যেখানে রয়েছে, এই বহু বহু বিশকে বহন করে যে, সে
বিশ্ব। বিশ ব।
প্রকৃতি সহজ। সঙ্গে জন্মে যা। সহিত-এ
জাত হয় যা, তাই সহজ। প্রকৃতি স্বভাব। স্ব এর ভাব যা, তা প্রকৃতি। প্রকৃত যা, তা প্রকৃতি।
প্রকৃতিতে যা প্রকৃষ্টরূপে জাত হয়, তা প্রজা। প্রকৃষ্ট জাতক। প্রজাপুঞ্জ। প্রকৃতিপুঞ্জ।
প্রকৃতিকে রঞ্জিত করেন যিনি, তিনি রাজ!
রাজ? হ্যাঁ,
রাজ। রঞ্জন করেন যিনি ব্যাপৃতভাবে, সার্বিকভাবে, তিনি রাজ। তিনি বর্ণিল, তিনি
রঞ্জক, তিনি ব্যাপক, তিনি সীমায়িত, তিনি ব্যাপ্ত। জনকে তিনি রঞ্জন করেন। প্রকৃতিকে
তিনি যাচ্ঞা করেন। আরো আরো প্রজা তিনি যাচ্ঞা করেন। তিনি রঞ্জন করেন ব্যাপ্ত হয়ে,
তিনি জ্ঞাত হন। তিনি জ্ঞান ধারণ করেন। জ্ঞান যাচ্ঞা করেন তিনি, প্রজা যাচ্ঞা করেন,
তিনি রাজ্ঞ।
যুগপৎ যিনি নিজেকে দান করেন ও
গ্রহণ করেন। রা। যিনি নিয়ত জায়মান। জ।
জন, যারা
প্রকৃতিপুঞ্জ, যারা প্রজা, তারা কি করবে? তারা কৃষিকর্ম করবে না? তারা মৃৎপাত্র,
তৈজসপত্র বানাবে না? তারা শিল্পসামগ্রী তৈরি করবে না? যে কৃষিকর্ম করলো, তার ফসল
কেটে নিয়ে গেল অন্য কেউ। যে শিল্পসামগ্রী বানায়, তার সামগ্রী কেড়ে নিয়ে যায় তেমন
কেউ, যার গায়ে বেশি জোর! কেউ মৃৎপাত্র বানায়, তা কেউ এসে ভেঙে দিলো। এমন তো হয়! যে
বলীয়ান, সে দূর্বলের থেকে কেড়ে নেয়, যে আক্রমণ করেনা, সে আক্রান্ত হয়। তাহলে? তাহলে
সবাই কি আক্রমণকারী হয়ে উঠবে? কুম্ভকার তার চাকা ঘোরাবে নাকি অস্ত্র ধরবে? কৃষক
তার লাঙল ধরবে নাকি অস্ত্র? নারী? নারীর কি হবে? নারীকেও রাখতে হবে অস্ত্র। তার
নিজের জন্য। অথচ সেও তো নিজের কাজেই থাকতে চেয়েছে। যে আক্রমণ করতে চায়না, তাকে যদি
আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে বাঁচবার জন্য সবাই আক্রমণকারী হয়ে উঠতে চাইবে। সবাই সবাইকে
মারবে। তাহলে জমিতে লাঙল চলবেনা, বস্ত্র উৎপন্ন হবেনা, শিল্পসামগ্রী তৈরি হবেনা।
সব থেমে যাবে। তাহলে?
জন জনকে মারছে, মানুষ মানুষকে আক্রমণ না করলে বাঁচছেনা, যে
জন দূর্বল, সে মরছে বা মার খাচ্ছে, কাঁদছে। যে মারছে, সেও কাঁদছে৷ সর্বত্র কাঁদছে
জন, কাঁদছে কৃষিক্ষেত্র, কুমোরের চাক, কাঁদছে পথ অরণ্য জনপদ। এই সকল কান্না সমবেত
হয়ে একজনের বুকে বাজলো। তাঁর হৃদয় মথিত হলো, মথিত হয়ে আকাশতুল্য হলো, সকলের কান্না
তিনি নিজে কাঁদলেন। তারপর এগিয়ে এলেন।
তিনি সব সমস্যায় মাথা দেবেন। তিনি জানবেন। জ্ঞ। কার কিসে সুবিধা, কার জন্য
কার কোথায় অসুবিধা তিনি জানবেন। জানবেন কে অধিকার করে অন্যের সম্পদ, কে অপরের গায়ে
ইচ্ছাপূর্বক ধাক্কা মারে, কার তুলির টানের ওপর ছিটিয়ে পড়ে রক্ত, কার ঘরের আঙিনায়
ঢুকে যায় আরণ্যপ্রাণী ও বন্যার জল। তিনি সব জানবেন, জানতে যাচ্ঞা করবেন।
সার্বিকভাবে জানবেন, বারবার প্রতিবার জানবেন, অন্যের জন্য, সকলের জন্য। সকলের
হিতের জন্য তাঁর জীবনের সমস্ত ক্ষণগুলি দান করতে হবে তাঁকে। নিজের সমস্ত শক্তি,
সকল শ্রম, পূর্ণ ক্ষমতাটুকু তাঁকে দিয়ে দিতে হবে। একবিন্দুও নিজের জন্য থাকবেনা।
নিজেকে এভাবে সম্পূর্ণ দিয়ে দেবেন
তিনি কাদের জন্য? প্রকৃষ্ট জাতকদের জন্য অর্থাৎ প্রজাদের জন্য। তিনি কি পাবেন? পাবেন
তাদের হৃদয়। পাবেন আনুগত্য। তারা তাঁর প্রতি উদ্বেল হবে। তাদের জীবনে ক্ষুৎপিপাসার
স্থান এত অধিক, যে তাদের অতো অধিক জন্ম হয়নি। সে জন্ম হচ্ছে তাঁর, নিয়ত। জন্মে জন্মে
তিনি তাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন, উঠে যাচ্ছেন অন্য সীমায়। তারা যাকে পূজা করে, সেই বিশ্বনিয়ন্তার
প্রতিভূ বানিয়ে নেবে তাঁকে। তিনি ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়ে তাদের জীবনে এসে ঈশ্বরের প্রতিনিধি
হিসেবে তাদের রঞ্জিত করবেন। যুগপৎ তিনি নিজেকে দান করবেন তাদের কাছে, এবং তাদেরকে গ্রহণ
করবেন নিজের মধ্যে। রা। জন্মিত হবেন ক্ষণে ক্ষণে। জ।
# # #
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে পড়েছেন তিনি। এভাবে একাকী,
অন্যের সহচর হয়ে ছাড়া তিনি বেরোন না সচরাচর। সোমযাগের সময় এসেছিলেন। কয়েকবার অগ্রজ
রাজপুত্রদ্বয়ের সঙ্গী হয়ে জ্যেষ্ঠতাতের আদেশে এসেছেন আগে। যদিও এ নগরী, নগরীর
বহির্ভাগ, পাশে অরণ্য, বেশ খানিক দূরে নদী, এ সবই তাঁর চারণভূমি। সবই তাঁর আবাল্য
পরিচিত। কিন্তু একক সম্পর্কে তিনি একটি তৃণের প্রতিও অধিকার বোধ করেন নি কখনো।
জ্যেষ্ঠতাত যেমন আদেশ করেন, তিনি সেভাবে তা মান্য করতে শিখেছেন। দাসীপুত্র জন্ম
থেকে নিজের অবস্থান চিনে যায়। সে অবস্থান চেনানোর জন্য তাঁকে ক্ষত্তা সম্বোধন না
করলেও, এমনকি কেউ আর্য সম্বোধন করলেও, সে ডাকের অন্তরালে অনুচ্চারিত ক্ষত্তা
শব্দটি তিনি শুনতে পান।
পূণ্যতোয়া গঙ্গা এখন ভরন্ত, সদ্য বর্ষাঋতু গত হয়েছে। দেব
চন্দ্রমাকে আর দুইবার পূর্ণ আকারে দেখবার মধ্যেই এসে যাবে শীত। নাগসাহ্বয়ে শীতঋতু
বড়োই কঠিন ও যুগপৎ স্বাস্থ্যকর। অপরাহ্নকাল, দেব দিনকর আরো দণ্ডদুই কিরণ দেবেন। আলোক
থাকতে থাকতে রাজপুরীতে ফিরতে হবে। উত্তরীয় পাড়ে রেখে, অধোবাস জানুর ওপর তুলে নিয়ে
জলে নেমে গেলেন তিনি। হস্তপদ প্রক্ষালন করলেন যত্নসহকারে। চোখেমুখে জল দিলেন।
ঘাড়ে, কানের আশেপাশের চুলের গোড়ায়। উত্তরীয় দিয়ে অঙ্গমার্জনা করে নিয়ে ফিরছেন
তিনি।
চাষী ফিরছে গৃহে বলদদুটি নিয়ে।
কমবয়সী পথিক দ্রুতপদে গৃহে ফিরছে, আহা, কান্তার মুখ মনে করে বুঝি বড়ো উচাটন! রাখালেরা
হৈ হৈ করতে করতে ফিরছে, তাদের তাড়িয়ে নেওয়া ধেনুর ক্ষুর থেকে ধূলি উড়ে পূণ্য করছে ধরণীর
আকাশ। নারীরা দুই চারজনে দলে দলে সিক্তবসনে কলসকাঁখে ফিরছে গৃহে, বৈকালিক স্নান না
হলে নারী বড়োই বিব্রত থাকে। অন্ধকার নেমে আসার আগে ক্ষুদ্র বণিক তাঁর দ্রব্যসামগ্রীর
মোট দাসের মাথায় চাপিয়ে ফিরছে, বড়ো বণিক ফিরছে গো শকটে। শিল্পকার তার শিল্পসামগ্রী
ঝুলিতে নিয়েই ফিরছে। ক্ষুদ্র পল্লীটির লাগোয়া কৃষিক্ষেত্রে অস্থায়ী আবাস বানিয়ে রয়েছে
এক মেষপালক। গ্রামবাসীরা তাকে তাদের চাষের জমিতে পশুগুলি নিয়ে থাকতে বলেছে। তাহলে তাদের
মলমূত্রে জমি সারবান হবে। এ সবই তাঁর পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে। এরা সবাই তাঁর অঙ্গবস্ত্র, তাঁর মার্জিত সম্ভ্রান্ত হাঁটাচলা
দেখে তাঁকে বড়ো কেউ মনে করে সম্ভ্রমসূচক দূরত্ব রেখে চলছে। তিনি জানেন, এ সম্ভ্রম আপাত।
তিনি ক্ষত্তা। বর্ণসংকর। দাসীপুত্র।
আশপাশের এই চলন্ত জীবন্ত পৃথিবী তার এত চেনা যে লক্ষ্য না
করলেও সবই দেখা হয়। আলাদা করে কিছুই লক্ষ্য করছেন না তিনি। ভাবছেন। ভাবছেন জন-এর
ইতিবৃত্ত। জন-এর মধ্যে থেকে কেউ রাজ হয়ে ওঠেন যখন, সেটা কিভাবে হয়েছিলো, তার নাম
রাজই বা কেন! সকল জনের কান্না কেঁদে যে মানুষের হৃদয় প্রসারিত হলো, তিনি হলেন রাজ।
জনের হিতের জন্য তিনি ধর্ম্ম সন্নিবদ্ধ করলেন, তা হয়ে উঠলো বিধি।
ঈশ কি? ঈশ হলো ব্যাপ্ত গতিময় শক্তির আধার। অসীম
আকাশতলে অগণন নদনদীপর্ব্বত উদ্ভিদ ও প্রাণী, তাদের নিয়ে কতোই না জন। কতো মনুষ্যযূথ
দূর দূর প্রান্তে। উদ্ভিদ সর্বদাই ভূতলে শিকড় প্রেরণ করে, উর্ধ্ব আকাশে কাণ্ড!
নদীজল সর্বদাই নিম্ন স্থানের দিকে গড়িয়ে যায়! মৎসেরা ভূতলে চরে না, ব্যাঘ্রমৃগাদি
প্রাণীকূল শুন্যে ওড়ে না, বিহঙ্গেরা জলে সন্তরণ করে না। প্রাণীদের, উদ্ভিদদের,
গিরিদরীর এবম্বিধ বিধি কে বেঁধে দিলো? যেমনভাবে রাজন্যরা বেঁধে দেন সমাজবিধি, তাই
তাঁরা লোকজ্যেষ্ঠক, তেমনভাবে এই সমগ্র চরাচরমাঝে যিনি সর্ব্বজ্যেষ্ঠক, এই
সমস্তকিছু যাঁর ইচ্ছানুসারে চলে, তিনি তো শ্রেষ্ঠ ঈশ! শ্রেষ্ঠ অর্থাৎ বর। ঈশ বর!
ঈশ্বর!
ধর্ম্ম কি? মর্ম্মকে যা ধারণ করে তা ধর্ম্ম। কার মর্ম্ম?
জনের মর্ম্ম। জনের সমবেত মর্ম্ম। জনের একক মর্ম্ম। সমবেত মর্ম্মে জন শান্তি চায়,
স্থিতি চায়, আপন রক্তমাংসের জনের হিত চায়, বাঁচতে চায়। একক মর্ম্মে প্রত্যেকে
পৃথক। যেমন জলের ধর্ম্ম নিম্নগতি। যেমন অগ্নির ধর্ম্ম দাহিকাশক্তি, যেমন মেঘের
ধর্ম্ম জলদান করা, যেমন নভের ধর্ম্ম রব, তেমনই কেউ চিত্র অঙ্কন করতে চায় তো অন্যে
তাতে শিউরে ওঠে, সেই শিহরণকে ভয়ে অনুবাদ করে সেই চিত্রকে নষ্ট করতে চায়। কেউ গায়ন
করতে চায় তো অন্যের কানে তাতে পীড়া হয়। কেউ অন্যের অর্জ্জন হরণ করতে পটু, তাতেই আনন্দ
পায়। এভাবে তো সব এলোমেলো হয়ে যায়। তাহলে চাই সেই বিধি, যা সকলের ধর্ম্মকে একত্রে
বহন করে। চিত্রকর চিত্র করবে, যার তাতে অসুবিধা, সে দেখবেনা। কিন্তু তার চিত্র
নষ্ট করে দেওয়া যাবে না। তেমনই, যে চায়না, চিত্রকরও জোর করে তাকে দেখাবেনা। যে
চিত্র চায়না, তার চিত্তেও স্থিতি রইলো, যে চিত্র করে, তার কৃতিও নিষেধ হলো না।
কৃষক যে শস্য ফলালো, তা কিনে নেবে বণিক। বণিক চাইবে কম দামে কিনে নিতে, কৃষক চাইবে
ফসলের দাম পেতে। বণিক তার লাভ করতে গিয়ে কৃষকের শ্রমের মূল্য দিতে চাইবে না। কৃষক
যাতে ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করবে বিধি। বণিক যাতে পণ্য যোগান দেবার চক্রে
সক্রিয় থাকার মতো মূল্য পায়, তা নিশ্চিত করবে।
বিধি এই। ব। বহন। ধ। ধারণ, আধার। বহন করা, অস্তিত্বকে
রক্ষা করা, ধারণ করা এবং গতিশীল রাখা। একক অস্তিত্বকে, যূথ অস্তিত্বকে। পাশাপাশি
অযূত অস্তিত্বকে। সকলকে।
ধর্ম্ম অনুসারে বিধি প্রণয়ণ করে, জনমনের রাজ হয়ে ওঠেন জনের
পতি, জনপতি, ক্রমে নর প্রজাতিরই পতি, নৃপতি। তখন যজ্ঞ তাঁর অবশ্যকর্ম হয়। যজ্ঞ কি?
যোজন, জন্ম, যাচ্ঞা। জনের জন্ম হয়, কিকরে হয়? যোজনে। কার কার যোজন? পুরুষ ও নারীর।
পুরুষ ও নারী কারা? তারা জনই। যারা যোনিবিশিষ্ট, তারা নারী, যারা লিঙ্গবিশিষ্ট,
তারা পুরুষ। জনন যেই যোনি ও লিঙ্গের, সেই বিপরীত অঙ্গসংস্থানের মিলনক্রিয়া। লিঙ্গ
কি? যা লীন হয়ে গমন করে বা গমন করে লীন হয়। যোনি কি? যাতে যোজন বিয়োজন হয়। তাদের
দ্বন্দ্ব হয়। দ্বন্দ্ব সংঘাত। দ্বন্দ্ব যোজন, মিলন। নরনারীর যোজনে কি পাওয়া যায়? প্রজা,
প্রকৃষ্ট জাতক। সন্তান। জনপতি কি যাচ্ঞা করেন? আরো আরো প্রজা যাচ্ঞা করেন, প্রজার
সুখ যাচ্ঞা করেন, রাজ্যের সমৃদ্ধি যাচ্ঞা করেন, প্রজাদের জন্য ধন যাচ্ঞা করেন। নব
নব জন্ম যাচ্ঞা করেন। তার জন্য যজ্ঞ করেন। যোজিত হওয়া, য। জনিত হওয়া, জ। যাচ্ঞা
করা, ঞ। যজ্ঞ।
যজ্ঞ ও দাস, রাজগৃহে এই দুই অতি
অবশ্য ঘটে। দাস কে? যে দত্ত হয়েছে, যাকে দান করা হয়েছে। যাকে কেউ দান করেছে বা যে নিজে
আত্মদান করেছে। দান করা হয়েছে, দ। সার্বিক দান, কোনো সত্ত্ব না রেখে, আ। সীমায়িত হয়েছে
তার ফলে যার আচরণ, স। সর্বাধাররূপে অ। সার্বিকভাবে যে দত্ত হয়েছে এবং সমসত্ত্বরূপে
যার আচরণ সীমায়িত, সে-ই দাস ও দাসী৷
দাস বা দাসী নিজেকে সম্পূর্ণ দান করে দেয় বলে জগৎ চলে। জগৎ
কি জানে, যে সেই দাস বা দাসী যদি নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় তবে তার উপর যে
নির্ভর, সে সম্পূর্ণ থেমে যাবে?
এ সমাজ, এ জগৎ দাসের দানের উপর টিকে আছে। পশ্চিম আকাশে
ছেঁড়া ছেঁড়া লঘু মেঘ, সেদিকে দৃষ্টি তুলে অক্ষিজল সংবরণ করলেন তিনি। মাতা, মা! সেই
মাতা যদি সেইসময় সেই দান না করতেন, তবে আজ কোথায় থাকতো, কোথায় থাকতো এই... থাক! এক
কুড়ি থেকে চার বৎসর কম বয়স তাঁর। মায়ের মুখের দিকে তাকালেই তাঁর বুক ভরে ওঠে, বুক
মুচড়ে ওঠে, চক্ষু আর্দ্র হয়! পথ অতিবাহন করতে লাগলেন বিদুর। সামনের বাঁকটি পেরোলেই
দেখা যাবে রাজবাড়ির সুউচ্চ চূড়া!
হেঁটে চলেছেন তিনি, ক্ষত্তা, বিদুর,
তাঁর পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে হস্তিনাপুর!
ঋণস্বীকার : রবীন্দ্রনাথ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দূর্বাদল মজুমদার, অভি সমাদ্দার,
ঋকপর্ণা ভট্টাচার্য!
আমার বলা সাজে না। একে বা এই কথককে এতো রক্তমাংসে চিনি যে বলতে গেলে পাল্লা একদিকে ঝুঁকে যাবেই। সুপ্রিয়, সখা আমার আমি শুধু টুপি খুলে অভিবাদন জানালাম। শুধু উত্তম বয়ান তাই একটি উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাহল তার অন্তরবয়নে সেই সময়কে প্রশ্ন করে তার জীবনীতে যা সে সচল হয়ে বুনে যাচ্ছে তার ভেতরে আরো এক সম বয়নকে মিলিয়ে দিতে পারে পাশাপা। যা আরো এক চিন্তনের অধিবাস খুলে খুলে যায়। এই উপন্যাসে সেই ভাষা তোর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে একই সঙ্গে দুই বাহিরি ও অন্তর বয়নকে মেলে দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলছে
ReplyDeleteআমার বলা সাজে না। একে বা এই কথককে এতো রক্তমাংসে চিনি যে বলতে গেলে পাল্লা একদিকে ঝুঁকে যাবেই। সুপ্রিয়, সখা আমার আমি শুধু টুপি খুলে অভিবাদন জানালাম। শুধু উত্তম বয়ান তাই একটি উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাহল তার অন্তরবয়নে সেই সময়কে প্রশ্ন করে তার জীবনীতে যা সে সচল হয়ে বুনে যাচ্ছে তার ভেতরে আরো এক সম বয়নকে মিলিয়ে দিতে পারে পাশাপা। যা আরো এক চিন্তনের অধিবাস খুলে খুলে যায়। এই উপন্যাসে সেই ভাষা তোর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে একই সঙ্গে দুই বাহিরি ও অন্তর বয়নকে মেলে দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলছে
ReplyDeleteশব্দের চাবি খুলে খুলে তার উত্পত্তি ও ক্রিয়াবাচক ভূমিকা সহ অর্থ নির্ধারণ বেশ ভালো । অন্যদের লেখাতেও কাজে লাগবে ।
ReplyDeleteশব্দের চাবি খুলে খুলে তার উত্পত্তি ও ক্রিয়াবাচক ভূমিকা সহ অর্থ নির্ধারণ বেশ ভালো । অন্যদের লেখাতেও কাজে লাগবে ।
ReplyDeleteশুধুএই পর্বটা নিয়েই একটা পূর্ণ নিবন্ধ লিখে ফেলা যায়। অতীতের ভাবনাগুলো বর্তমানকেও কেমন নাড়িয়ে দেয়। বিদূরের ভাবনা আসলে এই অসময়েরও মন্থন হয়ে উঠেছে।
ReplyDeleteসুপ্রিয় ভালো লাগলো।খেটে লেখা।
ReplyDelete