।। বাক্‌ ১৪৩ ।। অনুবাদ কবিতা ।। সোনালী চক্রবর্তী ।।






ফেডেরিক গার্সিয়া লোরকা
·         (১৮৯৮-১৯৩৬)

বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্প্যানিশ কবি ও নাট্যকার ফেডেরিক গার্সিয়া লোরকা ছিলেন জন্মসূত্রে অত্যন্ত শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। শিল্পী সালভাদোর দালি তাঁকে অতি অল্প বয়সে স্যুরিয়ালিজমের সঙ্গে পরিচিত করান যার প্রভাব তাঁর সৃষ্টিতে সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে। তাঁর নাট্যদলের নাম ছিল 'লা বারাকা'ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি তাঁকে গ্রানাডা থেকে বৈপ্লবিক কাজকর্ম, সমকামিতা ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেফতার করে কোনরকম বিচার ছাড়াই ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যা করে। মাত্র ১৯ বছরের কাব্যজীবন আণ্দালুশিয়ার এই বিতর্কিত কবির অথচ পৃথিবীতে কবিতার ইতিহাস যতবার লেখা হবে, তাঁকে কোন শক্তিই মুছে ফেলতে পারবে না।



* পলিত পন্নগ চরিত


রোদ্দুরে তাতা পোড়া একটা শুকনো রাস্তায়,
আমি সেই ধার্মিক টিকটিকি টাকে দেখতে পেয়েছিলাম।
(এক ফোঁটা কুমিরের মত)
শ্যামল খোলসের ভিতর,
এক শয়তানের মোহান্ত সেজে
সে তখন গভীর ধ্যানে।
তার সমাহিত আচরণ আর অনমনীয় টুঁটি,
একজন প্রাচীন অধ্যাপক সুলভ
নিখুঁত বিষণ্ণতার ভানে তাকে ঘিরে রেখেছিল।
বিচ্ছিন্ন এক শিল্পীর ম্লান দৃষ্টি দিয়ে,
সে কড়া পাহারায় রাখছিল অপরাণ্হ,
যেন তার কতই না আতঙ্ক।


এটাই কি তাহলে বন্ধু আপনার
সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব?
আরে দয়া করে বেতটা ব্যবহার করুন।
আপনি ভীষণ বৃদ্ধ হয়ে গেছেন মাননীয় টিকটিকি,
আর বলা কি যায়, এই অবস্থায়,
গ্রামের কোন বাচ্চা-কাচ্চাই হয়তো আপনাকে চমকে দিল।
হায় রে আমার অদূরদর্শী দার্শনিক,
আপনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী খুঁজছেন একটু বলবেন?
কখন দগ্ধ দুপুরের দোদুল্যমান প্রেতেরা
দিকচক্রবালকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়, এইটা?


মৃতপ্রায় নিয়তি থেকে
আপনি কি আশমানি খয়রাত চাইছেন?
কোন একটা ভাগ্যগ্রহের ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা?
অথবা ব্যাকরণের কোন অধ্যায় পড়তে পড়তে
উৎসাহ দিচ্ছেন সেই স্যাকরাদের,
ভাস্কর্যে পাখি কুঁদে তোলার সময়
যারা শব্দদের ছিটকে দিচ্ছে।
(আপনি অস্তগামী সূর্যের থেকে প্রত্যশা রাখছেন,
আর আপনার চোখ গুলো চকচক করছে খুব।
ওহো, আপনি তো ব্যাঙেদের রাজ্যে
লৌকিক আলো উগড়ানো ড্রাগন।
আপনার অভিপ্রায় গুলো
লগি বিহীন পলকা ডিঙির মতোন,
যারা ব্যর্থ হয়ে যায়
আপনার পুড়ে যাওয়া চোখের স্রোত জল পেরোতে।)


আচ্ছা, আপনি কি সেই ভয়াবহ সুন্দরী টিকটিকিটির অনুসন্ধানে এসেছেন?
বৈশাখের গম ক্ষেতের মত যে সতেজ,
ঘুমন্ত জলাশয়ের মত যার দীর্ঘ চুল,
যে আপনাকে ঘৃণায় প্রত্যাখান করে,
রণক্ষেত্রে ফেলে চলে গিয়েছিল।
ওহ, মধুর শরেদের ভিতর,
আপনি পড়েছিলেন,
ভগ্ন, একাকী অথচ জীবিত।
উফ্, আপদ আর কাকে বলে!
আমি তো এই জন্যেই আপনাকে এত পছন্দ করি।
খ্রিষ্টধর্মে, সর্বোচ্চ মার্গের দেবদূতদের
অভিজাত থুতনিতে,
সর্বদা বিজয় ঘোষিতই থাকে,
'সর্পকে আমি প্রতিহত করি'
জাতীয় নীতিবাক্যের।


এখন সূর্য পর্বতের পেয়ালায় লীন হয়ে গেছে।
আর সড়কে ভিড় জমিয়েছে মেঘ দল।
এই তো লগ্ন আপনার প্রস্থানের।
অসার পথ আর চিন্তন ত্যাগ করুন।
আপনি অনেক সময় পাবেন তারা গোনার,
যখন কৃমিরা তাদের অবসরে আপনাকে গিলবে।


হে টিকটিকি মহোদয়,
দেশের বাড়িতে ফিরে যান,
ঝিল্লী দিয়ে ঘেরা সেই পল্লীতে,
শুভরাত্রি, বন্ধু আমার।


এখন ময়দান অস্ত্রহীন,
পর্বতেরা ক্ষীণ,
রাজপথ পরিত্যক্ত।
শুধু, কখনো সখনও,
দীর্ঘ, কৃশকায় গাছেদের মাথায় জমে থাকা,
তমসার ভিতরে বসে,
একটা কোকিল কবিতা লিখছে।


** ঊষা অতীতে 


অথচ প্রেমের মতো
যে কোন ধনুর্ধর নিছক অন্ধ।


অনভিজ্ঞ রাতের গায়ে,
তীব্র ভক্তিগীতিরা ঠিকানা ছেড়ে যায়
আবেগী ফুলেদের।


চন্দ্রযানের চ্যাপ্টা তলদেশ
চূর্ণ হয় ময়ূরপঙ্ক্ষী মেঘে,
আর তাদের তূণীর ভরে ওঠে হিমে।


হ্যাঁ, কিন্তু প্রণয় যেমত
সমস্ত গাণ্ডীব দৃষ্টিশক্তিহীন। 



*** প্রথম পুরুষ

একটা রক্তের গাছ ভোরবেলাটাকে শুষছে,
যেখানে নাড়ি কাটা মেয়েটা গোঙাচ্ছে ভীষণ।
তার কন্ঠস্বর কিছু কাচ ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্ষতস্থানে,
আর শার্সিতে আঁকা থাকছে
হাড় গোড়ের একটা মানচিত্র।


স্বয়ামগতা আলোর স্থপতি
অধিগ্রহণ করে চলেছে
উপকথাদের শ্বেতাঙ্গ পরিধি,
ভুলিয়ে দিয়েছে
আপেলের স্থির শৈত্যের দিকে,
শূন্যযাত্রায়,
রক্তবাহদের তুমুল দাঙ্গার ইতিবৃত্ত।


আদম জ্বরের প্রলাপে,
তার দুই নাড়ির মধ্যে দিয়ে
লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসা একটা শিশুর
রক্তমাংসের স্বপ্ন দেখছে।

কিন্তু অন্ধকার আরেক আদমের কল্পনায় ভাসছে,
এক নপুংসক চাঁদের নির্বীজ নুড়ি উপত্যকার কথা,
যেখানে আলোর শিশুটিকে দগ্ধ করা হবে।



**** ঊষর কমলা তরুর কাব্য

কাঠুরিয়া,
শরীর থেকে আমার ছায়াকে অশরীরি করে দাও।
সন্তানহীন যাপনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও আমাকে।


কেন আমি জন্মেছিলাম দর্পণ বেষ্টিত হয়ে?
দিন ঘূর্ণিপাক খায়, খেয়েই যায় আমায় কেন্দ্রে রেখে।
রাত তার সমস্ত নক্ষত্রে আমারই প্রতিলিপি আঁকে।


আমি বাঁচতে চাই আমার প্রতিবিম্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
তারপর,
আমার স্বপ্নে যেন পিঁপড়েরা স্থান নেয় পাতাদের,
আর কাঁটা বীজদের সাজিয়ে নিতে পারি অজস্র তোতাপাখি করে।



***** ব্যভিচারিণী 


অপাপবিদ্ধ জ্ঞানে যাকে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়েছিলাম,
আগে থেকেই সে ছিল তার প্রভুর অধীনে।
উৎসবমুখর গ্রীষ্মের রাতে,
আমি যেন প্রায় কৃতজ্ঞই হয়ে পড়েছিলাম।
সমস্ত লন্ঠনদের নিভিয়ে দিয়ে
ঝিঁঝিঁপোকারা আলো জ্বেলেছিলো।
দূরতম গলিটার বাঁকে,
তার ঘুমন্ত স্তনেদের ছুঁতেই,
তারা যেন কচুরিপানার সুতীক্ষ্ণ ডগার মতো,
আমার কাছে উন্মুখ হয়ে উঠেছিলো সহসাই।
তার অন্তর্বাসের আড়ষ্ট শব্দ,
এক খণ্ড রেশমের মত আমার কানে এসে পৌঁছেছিল।
দশটা ছুরির কাছে ভাড়ায় খাটা
রূপোলি আলো বিহীন পর্নরাজিকে
দীর্ঘায়ত ঠেকছিলো চোখে।
কালোজাম আর নলখাগড়ার কাঁটাঝোপকে পিছনে ফেলে,
তার চুলের গোছার নিচে,
আমি মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়েছিলাম।
খুলে ফেলেছিলাম টাই,
সেও তার পোশাক।
আমি রিভলবার লাগান বেল্ট শরীর থেকে আলগা করতেই,
সেও সরিয়ে দিয়েছিল অবশিষ্ট যা কিছু আবরণ।
সুগন্ধি নিশিণ্দা অথবা খাঁটি মুক্তোও
তার ত্বকের থেকে বেশি মসৃণ ছিল না,
কোন রুপোর পানপাত্রকেও আমি এত উজ্জ্বলতা ছড়াতে দেখিনি।
চমকে ওঠা মাছের মত,
অর্ধেক আগুন আর অর্ধেক বরফ দিয়ে তৈরি
তার উরুগুলো আমার থেকে পিছলে যাচ্ছিল।
সেদিন রাতভোর,
জিনের রেকাব ছাড়াই,
ঝিনুকের অশ্বারোহী আমি 
শ্রেষ্টতম রাজপথ গুলোয় দৌড়ে বেরিয়েছিলাম।
একজন পুরুষ হিসাবে,
আমি কোনোদিন পুনরুত্থাপণ করবো না,
সেই রাতে সে যা যা বলেছিলো।
সহানুভূতির আলো আমায় বেশিই বুঝদার করে তুলেছিলো।
বালি আর চুমুতে ভিজিয়ে দিয়ে,
তাকে সরিয়ে এনেছিলাম নদীর পাড় থেকে।
লিলিফুলের তরবারিরা সেই সময়
হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাস্ত।
আমি সেই আচরণই করেছিলাম যা আমার প্রকৃত স্বরূপ,
ঠিক একজন আদিম যাযাবরের যা হওয়া উচিত।
রেখে এসেছিলাম,
খড়ের রঙ করা এক বিরাট মাপের
শিফনের সেলাই বাক্স।
কিন্তু তাকে আমি ভালোবাসিনি।
কারণ, স্বামী থাকা সত্বেও,
সে নিজেকে অনূঢ়া জানিয়েছিলো,
নদীতে নিয়ে যাওয়ার সময়।






19 comments:

  1. আগে অনেকের অনুবাদে লোরকা পড়েছি কিন্তু আপনার অনুবাদ অনেক স্বচ্ছ, আবেগের যথাযথ প্রকাশ।
    আপনাকে নমস্কার।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি না পড়লে আমার অনুবাদ অসম্পূর্ণ থাকে

      Delete
  2. পড়লাম।
    ইসস!!! মনটা খারাপ হয়ে গেলেও ভালো লেগেছে অনুবাদ।
    সত্যিই কবিতা নির্বাচন সময়েরই কথা বলে।
    আরো কিছু লিখতে ইচ্ছা হয়। থাক। পরে আবার ফিরে এসে পড়বো।

    ReplyDelete
  3. পড়েছি গতকালকেই....যথারীতি অপূর্ব...💐

    ReplyDelete
  4. মুল কবিতার নাম গুলো উল্লেখ করলে সেই গুলাও পড়তাম.... এই কবিতা গুলো খুবই ভালো লেগেছে

    ReplyDelete
  5. বরাবরই যা পাই দারুন

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো লাগলো সোনালী । ঝরঝরে এবং কবিতা নির্বাচনও খুব ভালো

    ReplyDelete
  7. এইমাত্র পড়ে শেষ করলাম...আপনার অনুবাদ নিয়ে বলতে যাওয়া মানেই ধৃষ্টতা...অসামান্য

    ReplyDelete
  8. তোমার অনুবাদের পাঠক আমি বহুদিন থেকেই । সেই এমিলি থেকে তোমার অনুবাদ পড়া শুরু । লোরকার লেখার অনুবাদ আগে পড়লেও এ লেখাগুলো অসামান্য অনুবাদ হয়েছে । ভাষা স্বচ্ছ, সাবলীল । ভীষণ ভাল কাজ হয়েছে এটা । বাক্-এর অ্যাসেট হয়ে থাকবে কাজটা ।

    ।। শুভদীপ নায়ক ।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরম মনে হয় । আদতে শূন্য ছাড়া অর্জন কিছুই নয়।

      Delete
  9. অন্যতম প্রিয় কবির কবিতার অনুবাদ ভাললাগল।

    ReplyDelete