।। বাক্‌ ১৪৩ ।। গল্প ।। শ্যামলী আচার্য ।।





মশাল দৌড়
শ্যামলী আচার্য

- টানা ছ’দিন হাঁটল ওরা? বলিস কী রে? তেরা দিমাগ ঠিক তো হ্যায়?
আরে ইয়ার বতানা কেয়া হ্যায়? তু খুদ হি দেখ লে। ইয়ে লে। তুই নিজেই দেখ...
ভোলানাথ তার মোবাইলে ছবি খুলে দেখিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরছে সকলে। একদল লোক। কারও কাঁধে বাচ্চা, পিঠে ব্যাগ, পাশে ঘোমটা খসে যাওয়া ক্লান্ত নারীমুখ। কেউ একদম একা। কালো, নিরন্ন মানুষ। ফাঁকা শুনশান রাস্তা। হাইওয়েতে খাঁ খাঁ করছে রোদ। অমন রোদের দিকে চেয়ে থাকা তো দূরস্থান, একঘণ্টা টানা হাঁটলে ছাতি ফাটবে নির্ঘাত। আর ওইভাবেই ছ’দিন? ওদের হাঁটার ছবি দেখেই চোখে অন্ধকার দেখে সনাতন।
ওরা তো সব লেবার। এভাবে ফিরছে? ফিরতে পারবে শেষ অবধি?
কিচ্ছু করার নেই। এই শালা লকডাউন হয়ে... কী যে এক আজিব বিমারি এল...  
হ্যাঁ। সবই তো বন্ধ। কিন্তু এক বাত সমঝ মে নেহি আ রহা... এই এত লোক... এরা সব ফিরছে কেন? লওটনা জরুরি হ্যায় কেয়া? 
তুই শালা চিরকালের বুরবাক।
ভোলানাথ থুতু ফেলে একদলা। গুটখা মেশানো খয়েরি থুতু ছিটকে গিয়ে লাগে পাঁচিলের কোণেআরও অনেকদিনের থুতু সেখানে জমানো। তার ওপরেই গিয়ে পড়ে।
ফিরবে না তো করবে কী? ঠিকাদার ওদের পয়সা দিয়ে পুষবে? কাজ বন্ধ। মালকড়িও বন্ধ। খানা মিলবে?
তবু, যে যেখানে ছিল কষ্ট করে কি সেখানেই থাকতে পারত না? উসে রহনা চাহিয়ে থা।
তোর দিমাগে সত্যিই ভুষি ভর্তি। আরে কদ্দিন বসে বসে খাবে?
তা ঠিক। সবাই তো আর আমাদের মতো কপাল করে আসেনি। হামারা বাত হি কুছ অলগ...
কপাল বলে কপাল! মালিক এখানে আমাদের থাকতে না দিলে কী হত বল তো? আর শুধু থাকা? কাজটাও তো শুরু হবে বলছে। কাম ভি রইল... খানা ভি মিল জায়েগা।
হাঁ... ভরোসা তো হ্যায়। আব বাদ মেঁ কেয়া হোগা...
ফিউচার কি না সোচ... উয়ো তো পতা ভি নেহি। কেয়া সে কেয়া হো গয়া... বরবাদ হয়ে গেল দুনিয়া।
এক বাত বোল। সাহাবদের তো অনেক তাকত। ওরা সব পটপট করে মরে যাচ্ছে কেন?
আরে ছোড় ভি। সাহাব হল তো কী হল? আদমি তো আদমি হি হোতা হ্যায় না! এই বিমারি কাউকে ছাড়ল না। প্যায়সাওয়ালে সে ভুখা পেট... সব বরাবর।
সব সমান হয়ে গেল, বল? ভগবানের আজিব খেল। সবকে সব বরাবর কর দিয়া।
আজিজুলের বড় ফোনে অনেক কিছু দেখা যায়। অনেক নদী পাহাড় রাস্তাঘাট পাখ-পাখালি গাছপালা দেশবিদেশের হরেক খবর। মাঝেমধ্যে ফোনে পয়সা ভরা থাকলে রাতবিরেতে ন্যাংটো মেয়েছেলেও দেখে ওরা। ওরা অনেকে। টিনের চালের একটানা শেড। পরপর অনেকগুলো শেডে মোট আটত্রিশ জন। আজিজুল, সনাতন, ভোলানাথ ছাড়াও আরও পঁয়ত্রিশ। ওরাও সবাই লেবার। কিন্তু গাজিয়াবাদের লিকার বটলিং প্লান্টের এই শ্রমিকদের কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এখানে ওরা ছাড়াও কর্মীরা রয়েছে অনেকেই। একদল অবশ্য থাকে একটু দূরে। ফ্যাকটরির বাইরে। কেউ কোম্পানির কোয়ার্টারে, কেউ নিজের মহল্লায়। তাদের উঁচু পোস্ট। শিফটিং ডিউটি। তারা এখন সবাই ছুটিতে। দূর থেকে যারা আসবে, তাদের তো এই লকডাউনে ফ্যাকটরিতে আসার কোনও উপায় নেই। কাজকারবার শুরু হলে আবার আসবে নিশ্চই। কিন্তু কারখানার মধ্যে থেকে যাওয়া এই লেবারদের রেখে দিয়েছেন দয়ালু মালিক। দূরদর্শী তিনি। এতদিনের অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া মালিকপক্ষ জানেন, সব কোম্পানি লকডাউনে মার খেলেও লিকার কোম্পানি ঘুরে দাঁড়াবেই। যে কোনওদিন খুলে যাবে বটলিং প্লান্ট, ডিস্টিলারি। আর ঠিক যে মুহূর্তে সরকারি ছাড়পত্র মিলবে, সেই মুহূর্তে প্রোডাকশনের কাজ শুরু করে দিতে হলে কিছু লোক কারখানায় রেখে দেওয়া জরুরি।
বুঝলি সনাতন, লোকে ভরপেট খাওয়া হলে মাল খুঁজবেই।
তা ঠিক।
সেইজন্যেই আমরা বেঁচে গেলাম শায়দ। উপরওয়ালা হামারি সুন লি!
হুম। কিন্তু তোর কি মনে হয় ওই লোকগুলো সব বাড়ি ফিরতে পারবে?
পারলে পারবে। আর না পারলে তোর আমার কী ছেঁড়া গেল?
আচ্ছা, এই গাজিয়াবাদ থেকে করণদিঘি কত মাইলের পথ হবে? তোর ওই যন্ত্র দেখিয়ে দেবে?
সনাতনের কথায় আজিজুল চুপ করে থাকে। মার্চ মাসের শেষে হঠাৎ যেদিন কাজ বন্ধের নোটিস এল, ছ্যাঁত করে উঠেছিল ওর বুকের ভিতরটা। কারখানার লকআউট কাকে বলে সে জানে। বজবজের জুটমিলের বন্ধ দরজার সামনে অনেক জীর্ণ মুখের সারি দেখে ওর বেড়ে ওঠা। কিন্তু লকডাউন শব্দটা ওর কাছে একেবারে নতুন। এটা কেন যে শুরু হল, কবে যে থামবে, তা-ও তো কেউ জানে না।
নেহি পতা। কভি কোশিস নেহি কি। তুই চাস তো নিজেই খুঁজে দেখে নে না।
আজিজুলের ফোনটা চাইবে ভেবেও চাইতে পারে না সনাতন। অন্য সময় হলে হয়তো চাইত। কিন্তু এই সময়টা কেমন অচেনাঠিক আগের মতো নয়। মুখে সর্বক্ষণ কী এক মুখোশ বেঁধে থাকতে বলছে পুলিশ। প্রথম কদিন এড়িয়ে গিয়েছিল সকলে। বুঝতেই পারেনি। তারপর মালিকের হয়ে ম্যানেজারবাবু বোঝাল। নিজে আসেনি অবশ্যওদের মধ্যে ভোলানাথের বয়স বেশি। একটু লিডার গোছের। তাকে ভিডিয়োকল করেছে। সকলে যেন সব সময় মুখ ঢাকা দিয়ে থাকে। আজিব বাত! এই গরমে... সহা নেহি যাতা। দম বন্ধ হয়ে যায়। গামছা জড়িয়ে কোনওমতে কাটল। কিন্তু মুখোশ আর কেনা হয়নি কারও। চারদিক শুনশান। সব দোকানপাট বন্ধ। এর মধ্যে কোথায় কে বেরোবে...। কে এসে বলল, বাড়িতে ফোন করে শুনেছে টিভিতে বলছে সারাদিন ধরে বারেবারে নাকি হাত ধুতে হবে... এই নিয়ে জোর হাসাহাসি হল একদিন। কারখানায় সারাদিন খাটনির কাজ ছিল। তখন ফুরসত পেলে তো। আর এখন কাজ একটু কম। কিন্তু হাত ধুয়ে বিমারি গায়েব, এই সাফসুতরা সাচ... বহোত পড়েশানি কি বাত।
ম্যানেজার বলে পাঠিয়েছে দরকার হলেও কেউ যেন কখনও কারখানা থেকে না বেরোয়। সপ্তাহে একদিন চাল-ডাল-আনাজ যতটা যা দরকার পৌঁছে দিয়ে যাবে কারখানার চত্বরে। কোনওমতে নিজেরা ফুটিয়ে খাওয়া। কিন্তু কাজের মানুষ অকাজে বসে থেকে খিচখিচ। মেজাজ ঠিক নেই কারও। শুধু রান্নাখাওয়া আর ওই মোবাইল। এছাড়া আর আছে কী? যে যখন বাড়িতে ফোন করে, তার কাছ থেকে যতটুকু কানে আসে, তা শুনে আরও দুশ্চিন্তা বাড়ে।
সনাতনের যেমন। করণদিঘির কথা মনে পড়ে রোজ। আজকাল এ এক নতুন বিমারি। রোজ মনকেমন। অথচ আড়াই বছর আগে এই প্ল্যান্টে যখন কাজ করতে আসে, তখন বাড়ি ছেড়ে বেরোতে পারলে ও বেঁচে যেত। মনা, শিবু, রতন, সিরাজ আগেই চলে গিয়েছিল সুরাট। তিনজন কাপড়কলে। একজন সোনার গয়নার কারিগর। ফেরেনি ওরা। টাকা আসত। গ্রামের সবাই দেখেছে ওদের বাড়িঘর সারানো হচ্ছে। বাপ-মা-বউয়ের হাসিখুশি মুখ। দিলখুশ। সনাতন আর দেরি করেনি সিদ্ধান্ত নিতে। ঢের হয়েছে। পঞ্চায়েতের জবকার্ড পাওয়া, ঠিকাদারকে খুশি করা... এতে পেট চলে না। নামেই একশো দিন। বছরে পঞ্চাশ দিন কাজ জোটে কিনা সন্দেহ। কাজ যদি বা আসে, ব্যাংকে টাকা ঢুকতে দিন গড়ায়। তার আবার ভাগ দিতে হয় পঞ্চায়েতের হর্তাকর্তা সুবীরকে। এত মেহনত কে করবে? তার চেয়ে বেশি পয়সা, জাদা মুনাফার দিকে ঢলে পড়াই ভাল। সেই তার করণদিঘি ছেড়ে এতদূরে চলে আসার সিদ্ধান্ত। মায়ের কান্নাকাটি, বাপের আপত্তিকে তখন পাত্তাই দেয়নি সনাতন। হালকা পিছুটান বলতে ছিল কমলা। বিয়ে করা ব না হলেও মনে মনে তাকে বউয়ের জায়গাই তো দিয়েছিল সনাতন। সে-ও যখন পুরুষমানুষের মুরোদ নিয়ে কটাক্ষ করল, তারপর আর...
কমলার কথা দিন দশেক হল মনে পড়ছে খুব।
এতদিনে কমলার বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। শেষবার কালীপুজোর সময় একবার বাড়ি গিয়েছিল সনাতন। প্রায় দেড় বছর পরে। দশদিনের ছুটিতে। ছোট ভাগ্নেটা জন্মাল, বাবার ছানি অপারেশন, অনেককিছু নিয়ে ব্যস্ততায় কেটেছিল সেই সময়। পাড়ায় অনেক বদল। ব্লক আপিসে নতুন পাঁচিল, রাস্তায় সুড়কির ওপর পিচের প্রলেপ। ওদের ছোট্ট টালির চালের বাড়ির পিছনের একফালি বাগানে শাক-পাতা গাছগাছালি অনেক। তার ছায়ায় বসে মা চোখ মুছে বলেছিল, আবার কবে আসবি বাবা...। এবার অন্তত একটা বিয়ে-থা কর। তার টানে অন্তত...
মায়েদের এইসব কথা শেষ হয় না। এগুলোর জবাবও হয় না। সনাতনের সাতাশ বছরের পেটানো শরীর নারীসঙ্গ চায় বইকি। রাত বাড়লে জমানো অতৃপ্তি মেটানোর জন্য কারখানার বস্তিতে নর্দমায় ছিটকে মিশতে থাকে কাঁচা খিস্তি আর টাটকা বীর্য। কিন্তু তার জন্য বিয়ে করে এই করণদিঘিতে আর কোনও বখেড়া বাড়াতে চায় না সনাতন। গাজিয়াবাদের কারখানা থেকে আড়াই মাইল এগিয়ে গেলে জওয়ানি হাতের নাগালে। একবার পয়সা দিলে কাজ হাসিল। দিল আর দিমাগ দোনো খুশ। ফালতু ঝামেলা বাড়িয়ে কী হবে?
সূরয বলে, ওদের গাঁয়ে করোনা মাইয়ের পুজো দিচ্ছে সব। করোনা মাইয়ের কোনও ছবি নেই। মূর্তিও নেই। একটা কাঁটা লাগানো পাত্থর কে মাফিক। লম্বা জিভ। লকলকে। রক্তমাখা। কত লোকের জান নিচ্ছে যে। ভুখা আত্মা। বিহারের কোন গ্রামে ওর বাস, সেখান থেকে গাঁয়ের বেরাদরদের এই নতুন পুজোর কথা জেনে বলছিল সকলকে। অনেকেই শুনতে শুনতে কপালে হাত ঠেকায়। সনাতনের আবার করণদিঘির কথা মনে পড়ে।
সেবার হাইস্কুল মাঠ থেকে বিডিও অফিস মশাল দৌড় হয়েছিল। কালীপুজোর আগের রাত। গাঢ় কালো আকাশের চাদর চিরে দেয় বাজির আলো। করণদিঘি থেকে ডালখোলা যাবার রাস্তায় মশাল নিয়ে দৌড়। কালীমূর্তি দেখার লাইন বিরাট। মাইকে গান। হইচই। করোনা মাঈয়ের জন্যও কি অমন আয়োজন... নেহি হো সকতা। ইয়ে কোই নওটঙ্কি হ্যায় কেয়া? ভাবতে ভাবতেই ঘরের এক ফালি চৌকি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে সনাতন।
বাইরে শুবি আজ?
শুতে পারি। ঘরমেঁ দম ঘুঁট রহা হ্যায়।
কারখানার দালানের বাইরের চত্বরে বড় খোলা রাস্তা। মাল লোডিং-আনলোডিঙের জন্য ট্রাক দাঁড়ায় একের পর এক। এখনও দাঁড়ানো কয়েকটা। স্থির। কোথাও যাবার নেই।
ওইদিকে শুই চল।
চল।
আজিজুল আর সনাতন দুজনে বিছিয়ে নেয় দুটো ছেঁড়া মাদুর। মাথার তলায় গামছা পাকিয়ে গুঁজে নেওয়া। পাশে ঘুমন্ত ট্রাকের আড়াল।
উয়ো সব আভি ভি রাস্তেঁ পর। হ্যায় না?
কওন?
ওই যে... লেবারলোগ। হাঁটছে। ঘরে যাবে সব।
কে জানে? ছাড় তো। যে হাঁটছে হাঁটতে দে। ম্যাঁয় নেহি যাউঙ্গা। আমি বেশ আছি। ঘরে গিয়ে হবে কী? আবার তো এখানেই ফিরতে হবে। তুই ফিরতে চাস? তোর ওই গাঁয়ে?
নাঃ... চাই না। করণদিঘি ইঁহা সে বহোত দূর। কিন্তু আজিজুল, আমরা কি আর কোনওদিন ফিরতে পারব? বাড়িঘর দেশে বেরাদরদের কাছে?
অন্ধকার আকাশে ঝকঝক করছে তারার মালা। মশাল হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতবর্ষ।

10 comments:

  1. খুব ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  2. দারুন! সপাট, বলিষ্ঠ

    ReplyDelete
  3. খুব সময়োপযোগী গল্প

    ReplyDelete
  4. খুব ভাল গল্প! দারুণ!

    ReplyDelete
  5. দারুণ লিখেছ, খুব ভাল লাগল

    ReplyDelete
  6. ভালো লেখা।বলিষ্ঠ বর্ণনা।
    শেষ নিয়ে একটু ভাবা যেত।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আগের কমেন্ট আমার।আমি সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়।

      Delete