।। বাক্‌ ১৪৩ ।।ব্যক্তিগত দর্শন : বাক্ স্বাধীনতা— ৩-য় পর্ব ।। শুভদীপ নায়ক ।।

চিত্র রচনা : সনৎ মাইতি 



ব্যক্তিগত দর্শন : বাক্ স্বাধীনতা-য় পর্ব

শুভদীপ নায়ক




আমার জীবনের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো সম্বন্ধে যদি আমাকে কিছু লিখতে বলা হয়, সেটা হবে নিঃসন্দেহে একটা কবিতার বইয়ের মতো । যেখানে বিচ্ছিন্ন কবিতার মতো প্রতিটা সম্পর্কের বিচারবোধ পৃথক । একটা অডিটোরিয়ামের মতো আমার জীবন, যেখানে সন্ধেবেলা প্রচুর মানুষের সমাগম হয় । তাদের বেশিরভাগই দর্শক এবং শ্রোতা । অনুষ্ঠানের আয়োজকরা যথাসম্ভব দর্শক আর শ্রোতাদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, কেননা আয়োজকদের দুঃখ কেউ নিতে চায় না, এবং এই কথা অডিটোরিয়ামটি অর্থাৎ আমার নিজের জীবনও জানে । অনুষ্ঠান যত বড়ই হোক, আর যত দীর্ঘই হোক, এমনকি তা অফুরন্ত আনন্দের হলেও একটা সময় পর তার পরমায়ু ফুরয় । ধীরে ধীরে সেই অডিটোরিয়ামের বাইরের দরজায় তালা পড়ে যায়, এবং যে প্রহরী অডিটোরিয়ামের দরজায় পাহারা দিচ্ছিল, সেও ফিরে যায় নিজের গন্তব্যে । সেই অবস্থায় নির্জনতা চেপে বসে অডিটোরিয়ামটির বুকে । যারা চলে গেল, তারা কেউ মধ্যরাত্রে ফেরৎ এসে দেখবে না কী অসম্ভব সত্য জ্বলজ্বল করছে নিরবিচ্ছিন্ন বিষণ্নতার মাঝখানে । সেই অডিটোরিয়াম এখন একা, অথচ একসময় সেটা আশ্রয় দিয়েছিল কত মানুষকে  
জগৎ বিপন্ন হতে থাকে । আমার সম্পর্কগুলো তৈরি হয়, ভেঙে যায়, বেঁচে থাকে তার সব অস্তিত্ব ঐ ভাঙনের মধ্যে দিয়ে । কিছুদিন পরে নতুন মানুষকে আমার আগের পুরনো মানুষটার মতো মনে হয় যার হাত থেকে পালিয়ে এসে আমি বেঁচেছি । আমার ভালবাসা মরে যায় । হাজার অভিযোগ ওঠে আমার বিরুদ্ধে । আমি সেসব মেনে নিই । পরাজিত হয়ে ফিরে আসি ন্যায়ের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে । সরে দাঁড়াই মানুষের জীবন থেকে অনেকদূরে । প্রতিমুহূর্তের সর্বনাশ আমায় ডাকে, আমার জীবনে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলোর মধ্যে ঘৃণার জন্ম হয় । যে ভালবাসাটা মরে যেতে বসেছিল, হারিয়ে যেতে চেয়েছিল, তা ফেরৎ আসে ঘৃণার মধ্যে দিয়ে । যার অর্থ হল নতুন করে জন্ম নেওয়া, আরও গভীরে যার মানে হল ফিরে ফিরে প্রেমেরই জন্য মরা ।
কিন্তু আমার ধৈর্য ও ব্রতটা সবকিছুকে বদলে দিল । সেই ব্রতটা আমার অর্জিত সমস্ত শিক্ষাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল, কেননা জীবনের জন্য আমার প্রয়োজন ছিল নতুন করে জ্ঞান অর্জন করা । আমার জীবন আমার সব সম্পর্কগুলোকে ত্যাগ করল, কারণ অামাকে তা কোনও অর্থে পৌঁছে দিচ্ছিল না । সেই অবস্থায় আমার জীবন ক্ষয় পেতে শুরু করে, এবং তা আমার সৃষ্টিগুলোকে অক্ষয় করে রাখার তাগিদেই । আমার চরিত্র যথাসম্ভব খারাপ হতে শুরু করে এবং ব্যাপারটা ভেবে আমি স্বস্তি পাই যে, আমাকে সেইসব মানুষের দলে পড়তে হয়নি যারা সমাজে ভাল সেজে বসে আছে । আমার চরিত্রকে তার অস্তিত্ব জানান দিতে কোনও আড়ালের সাহায্য নিতে হয়নি । প্রত্যক্ষ আমায় বড় করে তুলেছে, পরোক্ষ আমায় প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে ।
শৈশবস্থা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে 'বিশ্বাস' হল জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ । কিন্তু 'বিশ্বাস' শব্দটা যেহেতু পরিবর্তন সাপেক্ষ, তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত অন্য একটা কিছুতে আমাদের বিশ্বাস না জন্মায় ততক্ষণ আমরা আমাদের পূর্বের বিশ্বাস জিইয়ে রাখি । যদি নতুন যুক্তিতে বিশ্বাস রাখতে গিয়ে পুরনো যুক্তির প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ করতে হয়, তা হলে আমরা তাকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' বলি ! কিন্তু বিশ্বাসের প্রকৃত সংজ্ঞা কী ? 'বিশ্বাস' শব্দটার ওপর কেন কোনও মানুষ অযথা নির্ভর করবে ? বিশ্বাস গভীর হতে পারে, কিন্তু কখনওই তা সম্পূর্ণ নয় । এটা এমন একটা অন্ধকার যার অস্তিত্বের নিজস্ব কোনও গঠন নেই । অর্থাৎ, বিশ্বাস হল মানুষের মনে ঘটে চলা কোনও ঘটনার পূর্বশর্ত । সেই অর্থে বিশ্বাসঘাতকতাও একপ্রকার ঋণাত্মক বিশ্বাস বলা যেতে পারে । একইভাবে প্রেম হল মানুষের ভিতরে থাকা ঘৃণারই আনুপাতিক হার । এ কারণে মানুষের উচিত নিজের ভিতরে জানতে চাওয়ার বুঝতে চাওয়ার বোধ সৃষ্টি করা । কেননা, অন্য উৎস থেকে ধার করা জ্ঞান কখনও মানুষকে চিরন্তন সত্যে উপনীত করে না । 'বিশ্বাসকে মর্যাদা দিতে হবে'-- এই কথা আমরা পেয়েছি বই থেকে, সমাজ থেকে, অথবা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা থেকে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই জ্ঞান কৃত্রিম, এই আদেশ অনর্থক  । কারণ, এতে আমাদের অন্তরের বোধদীপ্ত যাচাই নেই । ঠিক তেমনি একজন পণ্ডিতের জ্ঞানও পুস্তক থেকে ধার করা, তাতে তার নিজস্ব ভাবনার ফলপ্রকাশ নেই । তেমনই প্রশ্নহীনভাবে স্বীকার করে নেওয়া যে জ্ঞান আপনি এতদিন তৈরি করেছেন, বা যে জ্ঞান আমরা অর্জন করে চলেছি, তা আসলে আমাদেরই ভ্রান্ত ধারণার অনুরূপ প্রভা । প্রকৃতপক্ষে আমি বা আমরা মানুষেরা কিছুই জানি না । আমরা মানুষেরা যতদিন বিশ্বাস করে যাব, ততদিন শোষিত হতে থাকব 
একজন পণ্ডিত মানুষকে বিশ্বাসের কথা বলবে, কিন্তু একজন দার্শনিক মানুষকে জানাবে যে, বিশ্বাসের চেয়ে আত্মঘাতী আর কিছু হতে পারে না । মানুষের সবসময় নিজের বোধের খোঁজে থাকা উচিত, কারণ বিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষ কোনওদিনই কিছু অর্জন করতে পারবে না । মানুষের প্রকৃত জ্ঞানার্জন তখনই সম্ভব হবে, যখন সে বিশ্বাসের ধারণা ত্যাগ করে নিজস্ব বোধের খোঁজ শুরু করবে । প্রচণ্ড ভুল শিক্ষার কারণে আমাদের মধ্যে এই ধারণা এসেছে 'বিশ্বাস' হল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, কিন্তু আসলে তা জীবনের নীতিবিরুদ্ধ । বিশ্বাস হল একপ্রকার অনুসন্ধানহীন স্থিতাবস্থা, যে অবস্থায় পৌঁছে মানুষ সত্যের খোঁজ করা বন্ধ করে দিয়ে একটা মিথ্যা নিরাপত্তার ওপর ভরসা করে  । বন্ধুতার প্রতি বিশ্বাস কিংবা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস এরকমই একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের মিথ্যা নিরাপত্তা । ঈশ্বরকে কখনওই বিগ্রহ বা মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যাবে না । কারণ, বাস্তবে 'ঈশ্বর' নামের কোনও পদার্থের অস্তিত্ব নেই । যিশুখ্রীষ্ট, মহাবীর, গৌতমবুদ্ধ, হজরত মহম্মদ, গুরুনানক--- এঁরা প্রত্যেকেই কোনও একটা সময়ের মানুষ ছিলেন, কিন্তু আজ বর্তমানে এঁরা সকলেই ঈশ্বরতুল্য । কিন্তু এঁদের প্রত্যেককেই বিগ্রহের ছাঁচে ফেলে এঁদের আদর্শকে সীমাবদ্ধ করে তুলেছে মানুষ । ঈশ্বরের উপলব্ধি কেবলমাত্র পাওয়া যায় জীবনকে মোকাবিলা করার মাধ্যমে । শুধুমাত্র জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়েই ঐশ্বরিক অনুভূতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব । এই উপলব্ধি খুঁজে পেলেই মানুষ নিজের ভিতরে আপনা থেকেই লীন হয়ে যাবে । অনেক মানুষ যখন একসঙ্গে সমষ্টিগত ভুল করে, তারা ভাবে সবাই যখন কোনও একটি ব্যাপারে একমত বা একইসঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, তখন সেটাই হয়তো সর্বসম্মত । এই কারণে সমষ্টিবদ্ধ জীবন শুধু ব্যবহারের উপযোগী, আবিষ্কারের নয় । একজন আবিষ্কারক শুধু একটি একা মানুষই হতে পারে । কারণ, সে তার প্রতিটি পদক্ষেপে প্রশ্নশীল । যাচাই না করে সে কোনও কিছুকে সত্য বলে মেনে নেয় না ।
কোনও এক গ্রামে গৌতমবুদ্ধ ধ্যান করার জন্য গিয়েছিলেন । সেই গ্রামে একজন জন্মান্ধ মানুষ বাস করতেন যাকে গ্রামবাসীরা কোনওভাবেই বিশ্বাস করাতে পারত না যে পৃথিবীতে আলো আছে । যখনই কেউ তাকে আলোর কথা বলত, সে সঙ্গে সঙ্গেই বলত, 'আমার তো শুধু চোখ দুটো নষ্ট, কিন্তু বাকি ইন্দ্রিয়গুলো তো সজাগ, তা হলে তোমরা আমাকে আলোর শব্দ শোনাও, তবে আমি মানব যে পৃথিবীতে আলো আছে । অথবা আমাকে আলোর স্পর্শ এনে দাও, কিংবা তোমরা আমাকে আলোর স্বাদ পাইয়ে দাও । যদি তা করতে না পারো, তা হলে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করব না যে আলো বলে কিছু পৃথিবীতে আছে ।' একথা শুনে গ্রামবাসীরা বুদ্ধের শরণাপন্ন হল । বুদ্ধের কাছে এসে তারা ঘটনাটা জানালো । সব শুনে বুদ্ধ বললেন, 'ঐ লোকটির চোখের চিকিৎসা করানো উচিত । আলো বলে কিছু যে পৃথিবীতে আছে, এটা তাকে বিশ্বাস করতে বলা অন্যায় কাজ হবে । কারণ, বিশ্বাসের কোনও নিজস্ব ভূমিকা নেই । তোমরা এখনই লোকটির চোখের চিকিৎসা শুরু করো ।' কিছুদিন পর লোকটি দৃষ্টি ফিরে পেয়ে বুদ্ধের কাছে এসে বলল, ' আমি ভুল ছিলাম, পৃথিবীতে সত্যিই আলো আছে ।' তখন বুদ্ধ তাকে বলল, 'কেউই ভুল ছিল না । তুমি তোমার দিক থেকে ঠিক ছিলে, বাকিরা তাদের দিক থেকে সঠিক ছিল । অন্ধের যেমন অন্ধকার সত্য, দৃশ্যের সত্য আলো ।'
এই কারণে আমি প্রায় বলে থাকি, বিশ্বাসকে যদি মর্যাদা দিতে হয়, তা হলে মেনে নিতে হবে অবিশ্বাসের মাহাত্ম্য । আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সমস্ত পাওয়া পেতে থাকি শূন্য থেকে, পাওয়া পূর্ণ হলে তা আবারও কোনও এক শূন্য ফেলে দিই । এরই মাঝে বাঁচতে থাকে আমাদের অখণ্ড জীবন ।

(চলবে)

6 comments:

  1. বেশ লাগল তোমার জীবনদর্শন

    ReplyDelete
  2. কত গভীরে গিয়ে ভাবতে পারা যায়, এটা শেখার মতো...অপূর্ব💐

    ReplyDelete
  3. কত গভীরে গিয়ে ভাবতে পারা যায়, এটা শেখার মতো...অপূর্ব💐

    ReplyDelete
  4. এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দারুণ

    ReplyDelete