জাপানি গুহা চিত্র
|
লেখালেখি বা
সাহিত্যজগতে বা কবিতায় কিছু কাজ করার পরেই আসবে হতাশা। সে ওই কাজটার পিছনের হাঁ
করে বসে আছে। সে বলবে সব ছেড়ে দিতে। কিন্তু হতাশা খুব চালাক জিনিস। প্রথমেই পুরোটা
বলবে না। প্রথমে বলবে শুধু লেখালেখি নিয়ে থাকতে, অন্য কিছুতে মন না দিয়ে। তারপর বলবে
লেখালেখি করাটাও কি আদৌ দরকার? কী হয় ছেড়ে দিলে? আপনি লেখালেখি বন্ধ করলে কারও কি
কিছু এসে যায়? প্রথমের
দিকে আপনি তার সঙ্গে সহজেই মোকাবিলা করবেন। একটা ধমক দিলেই সে ন্যাজ গুটিয়ে চলে
যাবে। কিন্তু আবার ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি
দিয়ে। এরপর যখন আসবে,
সে আরো শক্তি নিয়ে আরো বড় হাঁ করে আসবে। আগে যে উপায়ে তাকে তাড়িয়েছেন, সেটা আর কাজ
করবে না। অন্য উপায় ভাবতে হবে। যত বড় কাজ করবেন, তত বড় হতাশাও আসবে। আপনাকে আরো বড় বড়
উপায় ভেবে রাখতে হবে তাকে শায়েস্তা করার। সেলেবদের হতাশা আসে কি না বলতে পারছি না।
সেলেবরা জন্ম থেকেই শায়েস্তা খাঁ। কোবিদের তো আসেই না। কিন্তু হতাশা যদি আপনার না
আসে, আপনি
কবিলেখক নন। হতাশাই একজন ক্রিয়েটিভ মানুষের জীবনে টার্মিনেটর। সে শেষ অবধি আপনাকে খতম করবে। অথবা আপনি তাকে।
কিংবা... দুজনে মিলেই শেষ অবধি কোথাও পৌঁছে যাবেন, যদি শেষ বলে কিছু থাকে, পৌঁছনোর
কোনো জায়গা থাকে একজন কবিলেখকের জীবনে।
সমস্যার শুরু হয় যখন কেউ বুঝে ফেলে কবিতা কী করে লিখতে হয়। সে খুঁটিয়ে
বুঝে নেয় উৎপলকুমার বসু কীভাবে তাঁর সিনট্যাক্স রচনা করেছেন, কী কী প্রকারে
মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় রহস্যজাল বুনেছেন, বিনয় মজুমদার কেমন নগ্ন আর নির্জন
হয়ে উঠেছেন। সে বুদ্ধিমান। সে জানে কতটা একাগ্রতা লাগে। সে স্টাডি করতে থাকে,
অন্যরা ভাবে সে লিখতে শুরু করেছে। তার কবিতা ছাপা হতে থাকে। সম্পাদকদের সেই কবিতা
না ছাপার কারণ নেই। যারা বাংলা কবিতার হাড়মজ্জা জানে না, কিন্তু কবিতা ভালবাসে, সে
তাদের হাততালি এবং অভিনন্দনও পেতে থাকে। সিনিয়র কবিরা হ্লাদিত হয়, কারণ সে তাদের
মশালই হাতে তুলে নিয়েছে। খুব দ্রুত তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় ‘প্রতিশ্রুতিবান’,
‘সম্ভাবনাময়’ ইত্যাদি আখ্যা। সে মঞ্চে ওঠে, মঞ্চ থেকে নামে, মাটিতে পা রাখার সময়
খুব একটা পায় না। দশক কেটে যায়। হঠাৎ ক্যালেন্ডারের একটা তারিখে তার পা বেঁধে যায়,
সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দেখতে পায়, তার পরের প্রজন্মের সম্ভাবনাময় এবং প্রতিশ্রুতিবান
কবিরা এসে গেছে। তার কবিতা শেখার ফাঁকে কবিতা লেখা আর হয়নি। কবিতার মনোযোগী কিন্তু
অসফল ছাত্রের মতো মার্কশিট হাতে সে বেরিয়ে যায়, কোথায় যায়, কেউ খবর পায় না। ওই
তারিখটা তার এক্সপায়ারি ডেট ছিল।
আপনি একটা পত্রিকায় লিখলেন। এমন নয় যে আপনি প্রশংসার প্রত্যাশা করলেন।
নিন্দা আপনার প্রাপ্য নয়। আপনি চাইবেন মানুষ কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলুক। এটাও হয়ত
আশা করা ঠিক নয়। কিছু মানুষ আপনাকে নিয়ে কথা বলবে না। তারা পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার
আগেই আপনার ব্যাপারে নীরব হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ঠিক করে রেখেছে কাকে নিয়ে
কথা বলবে। আপনি দেখবেন পত্রিকায় চিঠি এল, বা সম্পাদককে ব্যক্তিগতভাবে জানানো হল
শুধু সেই কবির সম্পর্কেই। যেন আপনি লেখেনইনি। যেন আপনার কবিতা তারা পড়েইনি। এটা
কিন্তু নয়। তারা আপনার কবিতাটাই সবচেয়ে মন দিয়ে পড়েছে। কবিতার জগতে যেমন দুটো
শব্দের মধ্যে কবিতা লুকিয়ে থাকে, এই লোকগুলির নীরবতার মধ্যে লুকিয়ে আছে আপনার
সাফল্য।
অনুপম
মুখোপাধ্যায়
পরিচালক-
‘বাক্’
অনুপম, আপনার লেখাটি পড়ে বড় ভাল লাগল। বিষণ্ণ হলাম, কিন্তু বড় ভাল লাগল।
ReplyDeleteValo likhechhen
ReplyDeleteভালো লাগলো । অনেক কিছু বোঝার আছে, উপলব্ধি করার আছে
ReplyDeleteসহমত। ভীষণ সহমত।
ReplyDeleteযেটুকু লিখেছি ভেবেছি তার সবটাই বললেন আপনি ধন্যবাদ
ReplyDeleteসুগভীর বিশ্লেষণ
ReplyDelete" আপনার কবিতা শেখার ফাঁকে, কবিতা লেখা হয়নি " খুব মন দিয়ে পড়লাম।
ReplyDeleteকেয়া বাত... কেয়া বাত... মন ভরে গেল
ReplyDeleteবড় সুন্দর করে বললে গো অনুপম!
ReplyDeleteকমেন্টে এসে Curiousfellowর প্রতি কিউরিয়াস হয়ে পড়লাম যে বিশেষ কারণে তা হলো, ওনার কথাটি আমারও কথা। লাইনটি ঝপ করে যেন "ফাঁক"টির ঘেঁটিটা ধরেছে!
ReplyDeleteমনে হল আমারই কথা কেউ বলে দিল
ReplyDeleteখুব পছন্দ হলো প্রতিটি বিশ্লেষণ। আহামরি কোনো শব্দচাল নয়,মাকড়সার জালসুতো গুনে ফেলা যেন।
ReplyDeleteএকদম অন্য ধরণের সম্পাদকীয়
ReplyDeleteখুব সুন্দর উপস্থাপন। সমৃদ্ধ হলাম। শুভেচ্ছা।
ReplyDelete